অবৈধ স্ট্যান্ড থেকে ......

বছরে ৩০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি!

56
বছরে ৩০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি!

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

সড়ক দখল করে নগরীর প্রতিটি মোড়ে মোড়ে অবৈধ অটোরিক্সা-ইজিবাইক-মিশুক ও সিএনজি স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে এক শ্রেণীর চাঁদাবাজরা। এসকল চাঁদাবাজরা বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি করলেও অবৈধ এসব যানবাহনের কারণে সৃষ্ট যানজটে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। তবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর নিরবতায় হতাশ জনসাধারণ।

সরেজমিন, শনি ও রবিবার দিনভর নগরীর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, গলাচিপা মোড়, কালিরবাজারের সামনে, খানপুরে, নিতাইগঞ্জের মোড়ে, চাষাড়ায় পেট্রোল পাম্পের সামনে, শহীদ মিনারের পাশে, মহিলা কলেজের সামনে, পৌর মার্কেটের সামনে, খাজা মার্কেটের সামনে, রাইফেল ক্লাবের বিপরীত দিকে, নগরীর জিমখানা মোড়ে, ২নং রেল গেইট এলাকায় পুরাতন ডায়মন্ড হলের সামনে, ফজর আলী ট্রেড সেন্টারের সামনে, পুরাতন রহমত উল্লাহ ইন্সটিটিউটের সামনে, রেল গেইটের সামনের সিএনজি ও ট্যাক্সি স্ট্যান্ডসহ অন্তত ১৫টি মোড়ে অনুমোদনবিহীন স্ট্যান্ড রয়েছে। এসকল স্ট্যান্ডে প্রায় ৬ হাজার ইজিবাইক ও ১ হাজারের সিএনজি এবং ট্যাক্সি ক্যাব ভোর হতে রাত পর্যন্ত অবস্থান ও চলাচল করে।

অবৈধ ইজিবাইক-মিশুক ও অটোরিক্সার চালকরা কেউ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ফলে যত্রতত্র পার্কিং, পেসেঞ্জার উঠানামা করা, অযথা ওভারটেকিং, অতিরিক্ত গতিসহ নানা কারণে শহরের প্রধান সড়ক তথা বঙ্গবন্ধু সড়কের চাষাড়া থেকে ডিআইটি এবং সিরাজউদ্দৌলা সড়কের ১নং রেল গেইট থেকে কালিরবাজার পর্যন্ত তীব্র যানজট লেগে থাকে। শুধু প্রধান প্রধান সড়কই নয় প্রতিটি অলি-গলি, পাড়া-মহল্লায়ও একই চিত্র।

অবৈধ এসব স্ট্যান্ডের চালকদের সাথে কথা বললে তারা জানায়, পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারী দলের পাতি নেতাদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই এসব স্ট্যান্ড বসানো হয়েছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই স্ট্যান্ডগুলোর পেছনে রয়েছে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন। ট্রাফিক পুলিশের অসাধু সদস্যরা, কিছু রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ও মাস্তানরা এই স্ট্যান্ডগুলো থেকে নিয়মিত চাঁদা পকেটে নিচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিমখানা মোড় থেকে ১নং বাবুরাইলের মাথা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে অন্তত ৫০-৬০টি অবৈধ অটোরিক্সা, ইজিবাইক দাড়িয়ে থাকে প্রতিদিন। কাশিপুর, ডিগ্রিরচর, চর কাশিপুর এবং সৈয়দপুর এলাকায় চলাচল করে এ গাড়িগুলো। ব্যস্ততম রাস্তার পাশেই তাদের মিনি স্ট্যান্ড। অথচ এখানে ইজিবাইক স্ট্যান্ডের কোনো অনুমোদন নেই। এই স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন বিএনপি নেতা মজিদ, তার ছোট ভাই হাসান ও হাসানের স্ত্রী আফসানা আফরোজ বিভা হাসান। এখানে ৫টি রুটে মোট দুইশত করে ১ হাজারেরও অধিক ইজিবাইক চলাচল করে, লাইনচার্জ বাবদ প্রতিটি ইজিবাইক থেকে ১৫০ টাকা করে দৈনিক প্রায় দেড় লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সেই হিসেবে মাসিক চাঁদার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ এবং বাৎসরিক প্রায় ৬ কোটি টাকা।

একইচিত্র, নগরীর ২নং রেল গেইট মোড়ে পুরাতন ডায়মন্ড হলের সামনে দুইটি রুটে ৩’শ ইজিবাইক চলে। এখান থেকেও দৈনিক ১০০ টাকা হারে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। মাসিক ৯ লাখ টাকা হিসেবে বছরে প্রায় ১ কোটি টাকার বেশী চাঁদাবাজী করা হয়। অটোচালকদের অনেকে জানায়, কাউন্সিলরের লোকজন পরিচয় দিয়েই আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা তোলা হয়। চাঁদা না দিলে গাড়ি চালাতে দেয় না এবং মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ করেন ঐ চালক।

গলাচিপার মোড়ে ভোলাইল-বিসিকগামী ৫শতাধিক ইজিবাইক চলাচল করে। ফলে এখানেও গড়ে উঠেছে অবৈধ বিশাল এক স্ট্যান্ড। গলাচিপা এলাকার পাতি নেতারা অটো প্রতি ১২০ টাকা করে চাঁদা তোলেন বলেন বলে জানা গেছে। সেই হিসেবে এখানে দৈনিক ৬০ হাজার করে মাসে ১৮ লাখ এবং বছরে ২ কোটি টাকার বেশী চাঁদা তুলে ভাগ বাটোয়ারা করা হয়।

এমনি করে চাষাড়া রাইফেল ক্লাবের সামনে শিবু মার্কেট-সাইনবোর্ডগামী ৪ শতাধিক লেগুনা, সিএনজি ও অটো স্ট্যান্ড থেকে দৈনিক ২০০ টাকা হারে বছরে প্রায় ৩ কোটি, চাষাড়া পৌর মার্কেটের সামনে সিদ্ধিরগঞ্জগামী হাজার খানেক সিএনজি, টেম্পো, লেগুনা ও দুরন্ত গাড়ির অবৈধ স্ট্যান্ড থেকে ৫ কোটি, খাজা মার্কেটের সামনের স্ট্যান্ডের ৩ শতাধিক সিএনজি থেকে দৈনিক ১শ টাকা হারে বছরে ১ কোটি, ২নং রেল গেইট এলাকায় ফজর আলী ট্রেড সেন্টারের সামনের মুন্সীগঞ্জ-মুক্তারপুরগামী ৫ শতাধিক সিএনজি-অটোরিক্সা-ইজিবাইকের স্ট্যান্ড থেকে ১০০ টাকা করে বছরে প্রায় ২ কোটি, পুরাতন রহমত উল্লাহ ইন্সটিটিউটের সামনের ঢাকাগামী শতাধিক সিএনজি থেকে অর্ধকোটি, মিড টাউন মার্কেটের সামনের ৫ শতাাধিক সিএনজি ও ট্যাক্সি ২’শ টাকা হারে বছরে ৩ কোটির বেশী, নিতাইগঞ্জ মোড়ে ৩শতাধিক ইজিবাইক থেকে দৈনিক ১০০ টাকা হারে বছরে কোটি টাকার চাঁদাবাজি করা হয় বলে জানা গেছে। এছাড়াও পঞ্চবটি, পাগলা, শিবু মার্কেট, ঝালকুড়িসহ শহরের বাইরেও বহু অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে।

নগরবাসীর মতে, অবৈধ স্ট্যান্ডগুলোর কারণে এখন পায়ে হেটে চলাচল করাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সড়ক পার হওয়ার সময় বিপদে পড়ে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। শুধু স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাই নয়, অফিস-আদালতগামী কর্মজীবী মানুষ, সাধারণ জনগন এমনকি মুমুর্ষ রোগীদেরও চরম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। অনুমোদনহীন এসব স্ট্যান্ডে দন্ডায়মান যানবাহনের দাপট এতোটাই যে তারা সাধারণ মানুষ বা যানবাহন তো দুরে থাক এ্যাম্বুলেন্সকেও সাইড দিতে চায়না। ফলে প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে এসব স্থানে।

নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের অভিযোগ, মোড়ে মোড়ে অবৈধ স্ট্যান্ড ও অদক্ষ ইজিবাইক-সিএনজি চালকদের কারণে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য সংসারের কাজ ফেলে সন্তানদের পেছনে পড়ে থাকতে হয় স্কুল সময়ে। এরা সরকারি সড়ক দখল করে মোড়ে মোড়ে অবৈধ স্ট্যান্ড করায় সব সময় যানজট লেগে থাকে। এক শ্রেণীর মানুষ এদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে আখেড় গুছালেও সাধারণ জনগনকে পোহাতে হয় সীমাহীন ভোগান্তি।

নগরীর ২নং রেল গেইট এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, প্রায় ১২ বছর ধরে ২নং রেল গেইট এলাকার আশে পাশে কয়েকটি অবৈধ ও অনুমতিহীন সিএনজি-ইজিবাইক-ট্যাক্সির স্ট্যান্ড। কিন্তু যারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তারাই তো অবৈধ কাজের সুযোগ করে দেয় বলে জানান এ ব্যবসায়ী।

বেসরকারী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ভোর হতে রাত পর্যন্ত যেভাবে মোড়ে ইজিবাইক-সিএনজি-ট্যাক্সিগুলো পার্কিং করে রাখা হয়। এমনকি নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিতাইগঞ্জ থেকে চাষাড়াগামী, ১নং রেল গেইট থেকে ঢাকাগামী গাড়ীগুলোর ২নং রেল গেইট এলাকা পার হতেই সময় লাগে ২০ মিনিট।

সচেতন মহলের মতে, এসপি হারুন থাকাকালীণ সময়ে নিয়মিত এসব স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে স্ট্যান্ডগুলো বন্ধ করার কাজ চলমান ছিলো যা নগরবাসীর ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব করেছিলো। তবে তিনি চলে যাওয়ার পর প্রশাসন আর এদিকে নজর দেয় না।

নগরবাসী বলছে, যেহেতু প্রায় সবগুলো অবৈধ স্ট্যান্ডই সিটি কর্পোরেশন এরিয়ার মধ্যে, সেহেতু এসব অবৈধ ও অনুমতিহীন স্ট্যান্ডগুলো বন্ধে এবং নগরবাসীকে শান্তির ব্যবস্থা করতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনকেই এগিয়ে আসতে হবে।

পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, কোনো পুলিশ সদস্য এসব অপকর্মে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদে আমাদের অভিযান চলমান।