আরো বাড়তে পারে দ্রব্যমূল্য, কমবে বৈদেশিক আয়...

দেশের অর্থনীতিতে মহা বিপদ আসন্ন

206

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

দেশে যদি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হয় তাহলে একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে এ দেশের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণও নেই। বরং তা আরও গভীর ও খারাপ হচ্ছে। অর্থনীতির অনেকগুলো সূচকই আরও দুর্বল হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট আরও বেড়েছে। খাদ্য সংকটের আশঙ্কাও বাড়ছে।
চলতি বছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমেছে ১১ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের গতি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম হওয়ায় লেনদেনের ঘাটতি এখন রেকর্ড পরিমাণ।

সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন মূল্যস্ফীতি। এতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, কমেছে প্রকৃত আয়। উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট। উৎপাদন কম হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো হিমশিম খাচ্ছে ডলার নিয়ে। সরকারের আয়ও কম। ফলে ভর্তুকির বরাদ্দও বাড়াতে পারছে না।

বিশ্ব অর্থনীতি নিয়েও কোনো ভালো কোনো পূর্বাভাস নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগ্রাসীভাবে চলতি বছরেই ছয় বার নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। তারপরও মূল্যস্ফীতি তেমন কমছে না। বরং এর ফলে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা আরও বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, খারাপ সময় আসা এখনো আরও বাকি। বিশ্বে সামনে প্রবৃদ্ধি আরও কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। অর্থাৎ ২০২৩ সালও ভালো যাবে না।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে একধরনের চাপ আছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নই। এখন পর্যন্ত সূচকগুলো যে পর্যায়ে আছে, তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়মিত করতে পারলে উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

তাহলে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সমর্থন পেলে ডলারের সংকটও কেটে যাবে। খাদ্যসংকটের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আমনের ফলন ভালো হয়েছে। বোরোর ফলনও ভালো করার প্রস্তুতি চলছে। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে সতর্ক আছি।’

দেশের মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে এর হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস হলো ২০২৩ সালে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ হবে। এর মানে, মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভবিষ্যতেও স্বস্তির খবর নেই।
গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। কিন্তু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেলে অল্প অল্প করে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর খানিকটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
আর তাতেই ডলারের দর গিয়ে ঠেকেছে ১০৭ টাকায়। আবার বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা শুরু করে।

এতে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ৩ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলারে, যা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যাবে, যা কয়েক মাস আগেও ছিল সাত মাস। যদিও আইএমএফের মতে, হিসাবটি পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, নানা কারণে ৭২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছিল, এর পুরোটা ফেরত আসার নিশ্চয়তা কম। সেই হিসাবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৭১৩ কোটি ডলার।

আবার সরকারের সামগ্রিক আয়-ব্যয়ও এখন অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সরকার লক্ষ্য অনুযায়ী আয় করতে পারছে না, কিন্তু খরচ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি তেল ও সারে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু সরকার আর এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারছে না। এ কারণেই জ্বালানির দাম এক দফা বাড়ানো হয়েছে। এখন চাপ রয়েছে সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর মূল উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। দুটির ক্ষেত্রেই আয় টানা দুই মাস কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানাচ্ছে, অক্টোবরে রপ্তানি আয় গত বছর একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর মাসে কমেছিল সোয়া ৬ শতাংশ। অথচ এর আগে টানা ১৩ মাস রপ্তানি আয় বেড়েছিল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। রপ্তানিকারকদের আশঙ্কা, সামনে এই আয় আরও কমবে। কারণ, পোশাকের ক্রয়াদেশ কমে যাচ্ছে।

আবার গত অক্টোবরে আসা প্রবাসী আয় গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সব মিলিয়ে গত চার মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি সামান্য, মাত্র ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ৯ লাখের বেশি শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। তাঁরা আয় পাঠানো শুরু করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে এ জন্য বাজারদর মেনে বিনিময় হার ঠিক করাটা জরুরি। নইলে হুন্ডি আরও বাড়বে। যদিও অর্থ পাচার ঠেকানোর কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ সরকারের নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়েছে। সে সময়েই বাংলাদেশ জ্বালানির দর ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে একপ্রকার ডেকে আনে। আবার ডলারের উচ্চ দর সামলাতে যখন বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কে কীভাবে বিক্রি করছে, কে বেশি মুনাফা করছে, তা নিয়ে তদন্তে নামে। এরপর প্রধান প্রধান ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতে উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। ফলে সে পথ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক সরে যেতে বাধ্য হয়। তারপর বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রিত ভাসমান করা হলেও এখনো একাধিক বিনিময় হার রাখা হয়েছে। হুন্ডি প্রবণতা কমারও লক্ষণ নেই। এখনো বিনিময় হার নিয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, আবার তা বদলেও ফেলা হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হচ্ছে না।

ডলারের চাপ কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। রপ্তানি আয় যাদের নেই, তাদের ঋণপত্র খুলতে চাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে অনেক ব্যবসায়ীই ঋণপত্র খুলতে পারছে না বলে পণ্যসংকট দেখা দিয়েছে। খাদ্যের আমদানি কমে গেছে। চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে এ কারণেই।

সামনে মহাবিপদ, অর্থনীতির সঠিক পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কে জন্ম নেওয়া মার্কিন অর্থনীতিবিদ নুরিয়েল রুবিনির বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে। তিনি গতকাল সোমবার ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান–এ লিখেছেন, বিভক্ত রাজনীতির এই বিশ্ব এখন ভবিষ্যতের কথা না ভেবে স্বল্পকালীন পরিকল্পনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে মানুষের জীবন আরও খারাপ অবস্থায় চলে যাচ্ছে, দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের মহা হুমকি। তাঁর বিবেচনায় অর্থনীতির সামনের মহা হুমকি হচ্ছে, একই সঙ্গে মন্দা ও মূল্যস্ফীতির উপস্থিতি এবং সরকারি ও বেসরকারি ঋণ পরিশোধের দায়ের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এক জরিপ করে দুই দিন আগে বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণ পরিশোধের সংকট এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিই হচ্ছে আগামী দুই বছরের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ফীতি কমাতে যেভাবে সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে মন্দা অবশ্যম্ভাবী বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।

সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির সংকট আগামী বছরেও যাবে না বলেই সবাই পূর্বাভাস দিচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, কয়লা ও এলএনজির দামও শিগগিরই কমবে না। ফলে বিদ্যুৎ খাতের সংকট মিটছে না। বরং এই সংকট বেসরকারি খাতে উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে। বিক্রি কমে গেছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখ দেখছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। এ রকম এক অবস্থায় ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে আলোচনার জন্য আইএমএফ প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায় অবস্থান করছে। সংস্থাটি কী শর্ত দেয়, বাংলাদেশ কতটা পূরণ করতে পারবে তার ওপরই নির্ভর করছে ঋণের ভবিষ্যৎ।

বাংলাদেশের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব পরিস্থিতি দুই দিক থেকেই ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। রপ্তানি ও প্রবাস আয়ে শ্লথগতি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদা থাকলেও কলকারখানা উৎপাদন করতে পারছে না। ডলার সাশ্রয়ের জন্য ডিজেলসহ জ্বালানি তেল আমদানিতে রাশ টানা হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ সংকট হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। আবার শিল্পে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের আগে অগ্রাধিকার ঠিক করা উচিত।’

(সূত্র : আইএমএফ, বিশ^ ব্যাংক সহ বিভিন্ন সংস্থা)