পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং কেন?

434
পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং কেন? রুদ্র প্রকাশ: আমাদের দেশে অদ্ভুত এক সংস্কৃতি চালু হয়েছে। কোন ঘটনা বা বিষয় এলে তা ধারাবাহিকভাবে আসতেই থাকে, ঘটতেই থাকে। কিছু বছর আগেও ইভটিজিং ছিলো আলোচনায়। হালে এসে ঠেকেছে কিশোর গ্যাং।

রুদ্র প্রকাশ: আমাদের দেশে অদ্ভুত এক সংস্কৃতি চালু হয়েছে। কোন ঘটনা বা বিষয় এলে তা ধারাবাহিকভাবে আসতেই থাকে, ঘটতেই থাকে। কিছু বছর আগেও ইভটিজিং ছিলো আলোচনায়। হালে এসে ঠেকেছে কিশোর গ্যাং। পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং! দাড়ি-গোঁফের কিছুটা রঙ উঠার সাথে সাথেই ছেলেপুলেগুলো হঠাৎ আক্রমনাত্মক হয়ে উঠছে। কী ভয়ঙ্কর! অতীতে এ বয়সের ছেলেপুলেরা এপাড়া থেকে ওপাড়াও যেতে ভয় পেতো। কিন্তু এখন তারাই ঘটাচ্ছে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে-হঠাৎ নতুন এই সংস্কৃতি কেন চালু হলো? কীভাবে এসব কিশোরদের হাতে আধুনিক চাকু ও অন্যান্য অস্ত্র উঠে এলো। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কিশোর গ্যাং নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান থেকে ঘুরে আসা যাক।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২ বছরে ৩৪ জন খুন হয়েছেন। এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরকে আসামি করা হয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীতেই ৩৪টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। র‌্যাবের প্রতিবেদনে এর সংখ্যা আরও বেশি।

আগে ঢাকার শিশু আদালতে শিশু-কিশোরদের মামলার বিচার হতো। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারির পর থেকে এসব মামলার বিচার ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলছে। ঢাকার শিশু আদালতে ২০১৮ সালের ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৬টি খুনের মামলার বিচারকাজ চলে। ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে এসব খুনের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী দুই বছরে ঢাকায় আরও ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটে।

এসব শুধু রাজধানীর পরিসংখ্যান, যদিও বাস্তবতাও আরও ভয়াবহ। শুধু রাজধানী নয়, শিল্প-নগরী নারায়ণগঞ্জেও কিশোর গ্যাং এর সংখ্যা কম নয়। পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে এসব অপরাধীদের তাপ কমে এলেও। রোববার রাতে নারায়ণগঞ্জে একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি আবারও সামনে এলো। সে রাতে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজের পুত্রের উপর হামলা চালায় একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অনন্ত নামের ওই কিশোর আহত হয়।

কিশোররা কীভাবে গ্যাং গড়ে তোলে, কীভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে?-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। তবে রাজনৈতিক দলের ‘বড় ভাই’র প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠা কিশোর গ্যাং এর সংখ্যাই বেশি। তারা আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনাখুনিতে কিশোরদের ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে।

কিশোর গ্যাং নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একজন অধ্যাপক বলছেন, কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িতরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তারা অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো ‘বড় ভাই’র সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে।

গবেষণার সূত্র ধরে তিনি আরও বলছেন, আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রশমিত না হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক।