নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতিতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা

195

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এবং কতিপয় সদস্যদের নিয়ে তৈরি হওয়া একটি দুষ্ট চক্রের খাম-খেয়ালিপনার কারণে লঙ্কাকান্ড চলছে নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতিতে। নগরীর পশ্চিম দেওভোগস্থ নাগ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত এ চিকিৎসা কেন্দ্রের সেবা থেকে নারায়ণগঞ্জবাসীকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে নবীন ও পুরনো কতিপয় সদস্যদের যোগসাজসে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করা হচ্ছে হাসপাতালটিতে।

এ চক্রান্তের মূল লক্ষ্য সমিতির অর্থ লুটে পুটে খাওয়া এবং হাসপাতালের কর্তৃত্ব নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখা। বিগত দিনে এই সুযোগ না পেয়ে ইতিমধ্যে সমিতির এক প্রবীন সদস্যকে বানোয়াট তথ্য ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তড়িঘড়ি করে সমিতির নির্বাচনের আয়োজন করেছে চক্রটি। যদিও নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি ও সমিতির কয়েকজন সদস্যদের অসদাচরন এবং বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে গত দুই নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা শাহ ফতেহ উল্লাহ সেলিম ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, চক্রটি ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের প্রথম সভার কাগজপত্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুন্দর ও সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হয়ে আসছিল নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সৌহাদ্যপূর্ন সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। কিন্তু প্রয়াত সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের উদ্যোগে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর সহ-সভাপতি ও দীর্ঘ ১২ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর জীবন সদস্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অথচ দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি হাসপাতালে বিভিন্ন পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। এক পর্যায়ে সমিতির নব্য ও অর্থলোভী সদস্যদের দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন ডা. শাহওনেয়াজ চৌধুরী। জনৈক ইব্রাহিমের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন দপ্তরে শাহনেওয়াজ চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়। তবে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্তে প্রমানিত হয় ইব্রাহিম কোন অভিযোগ করেননি। বরং এ ওয়াই এম হাসমত উল্লাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হতে না পেরে অভিযোগ করিয়েছেন বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। কারণ তদন্তের দিন তিনি সকাল বেলা রাঙ্গামাটি থেকে ফোনে প্রলোভন দেখিয়েছেন। পরবর্তীতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাশমত উল্লাকে নির্বাহী পরিষদের সভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবে বহিস্কার করা হয়। এরপরই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেন হাসমত উল্লাহ গং। তদন্তে ম্যাজিস্ট্রেট এটাও উল্লেখ করেন যে, সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন চুন্নুর নিয়োগ বিধি মোতাবেক হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমিতির বেশ কয়েকজন সদস্য জানান, নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি ও ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে অনৈতিকভাবে ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর আজীবন সদস্য পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে। একজন রিটায়ার্ড সরকারী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দীর্ঘদিন ধরেই চাচ্ছিলো ডা. শাহনেওয়াজকে ডায়াবেটিক সমিতি থেকে বের করে দিতে। তারই অংশ হিসাবে এবার ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে তার সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে বলেও জানান তারা। এর কারণ হিসাবে তারা বলছেন, ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী সহ-সভাপতি ও সভাপতি পদে থাকাকালীণ সময়ে কেউ কোনো লুটপাট-দুর্নীতি করতে পারে নি বা নিজের আখের গোছাতে পারে নি তাই স্বার্থান্বেষী ওই মহলটি এবার তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। তিনি যখন এ সমিতির দায়িত্বে ছিলেন তখন কাউকে কোনো নিয়ম বহির্ভূত কর্মকান্ড করতে দেন নি। যখনই কেউ লুটপাট-দুর্নীতি করতে চেয়েছেন, তখনই বাধা হয়ে দাড়িয়েছেন ডা. শাহনেওয়াজ। আর এটাই হচ্ছে তাকে অপসারণ করতে চাওয়া চক্রান্তের মূল কারণ। তারা আরও বলেন, ডা. শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে যেভাবে হাশমত উল্লাহ অভিযোগের তীর ছুড়ছেন তদন্ত করলে দেখা যাবে সেই সকল কাগজে হাশমত উল্লাহরই সাক্ষর রয়েছে। কথা বলে ষড়যন্ত্রকারীদের পাল্লা ভারী হয়ে গেলে কিছুই করার থাকেনা সঠিক ব্যক্তির। এমনটাই হয়েছে এই হাসপাতালে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আমাদের হাতে এসেছে বেশ কয়েকটি ডকুমেন্ট। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে ১২ জন গুণীজনকে সাথে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির প্রথম প্রস্তুতি সভা সম্পন্ন হয়। যেখানে ৫ নম্বরে রয়েছে ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর নাম। এখানে আরও ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক মজিবুর রহমান বাদল, সমাজ সেবক জহিরুল হক মিস্টার, ডা. মহিবুল ইসলাম প্রমুখ। ওই সভায় ৭ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক আহবায়ক কমিটি গঠন করে পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে ১৯৮৭ সালের ২৫ জানুয়ারী ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এখানেও ৫নং সদস্য হিসাবে রয়েছেন ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী। সেদিন তারা প্রত্যেকেই ১০০০ টাকা করে চাঁদাও প্রদান করেন।

পরবর্তীতে ১৯৯৫-৯৭, ৯৮-২০০০, ২০০১-০৩, ২০০৪-০৬ ও ২০০৭-০৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ মেয়াদে মোট ১৫ বছর মহাসচিবের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ডা. শাহনেওয়াজ। সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের প্রয়ানের পর ২০১০-১২, ২০১৩-১৫, ২০১৬-১৮, ২০১৯-২১ সাল পর্যন্ত ৪ মেয়াদে মোট ১২ বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ডা. শাহনেওয়াজ। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৩-১৫ সালের নির্বাচনের সময়ে নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এ, ওয়াই, এম হাশমত উল্লাহ।

ডা. শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে মূলত যে অভিযোগটিকে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে তা হলো, সমিতির রেজ্যুলেশ খাতায় উনি জনৈক ইব্রাহিম সাহেবের নাম কেটে তার নাম লিখে আজীবন সদস্য হয়েছেন। যদিও এ অভিযোগের বিষয়ে ইব্রাহীম সাহেবের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ডা. শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করিনি। সৎ সাহস না থাকার কারণে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে কেউ হয়তো আমার নাম ব্যবহার করে এ অভিযোগ করেছে।

শাহনেওয়াজ চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনিত আরেকটি অভিযোগ হলো তিনি অধিক দামে মিশনপাড়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন, কিন্তু এ বিষয়ে প্রাপ্ত ডকুমেন্টে দেখা যায়, ডায়াবেটিক সমিতির পক্ষ থেকে ক্রয়কৃত এ ফ্ল্যাটের দলিলে প্রথম স্বাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর করেন বর্তমানে ডা. শাহনেওয়াজের বিরোধীতাকারী এ, ওয়াই, এম হাশমত উল্লাহ নিজেই।

এ বিষয়ে সমিতির সদস্যদের প্রশ্ন, ডা. শাহনেওয়াজের সদস্য পদ যদি অবৈধ হয়ে থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালীণ সময়ে এ, ওয়াই, এম হাশমত উল্লাহ সাহেব কেন তা যাচাই-বাছাই করেননি। এছাড়া ফ্ল্যাট ক্রয়ের সময় যদি অধিক দাম দিয়ে তা কেনা হয়ে থাকে তাহলে এ, ওয়াই, এম হাশমত উল্লাহ সাহেব তখন কেন স্বাক্ষর করলেন এবং কেন তিনি তখন বাধা দেননি?

এদিকে, ডা. শাহনেওয়াজের দাবি ছিলো, তিনি কোনো লেখা কাটাকাটি বা ওভাররাইটিং করেননি বরং ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এমপি আফজাল হোসেন নিজেই ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর নাম লিখেছেন। এ দাবির বিষয়ে প্রয়াত এমপি আফজাল হোসেনের পুত্র তারেক আফজালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ অভিযোগটির সাথে আমার পিতার ভাবমূর্তি জড়িয়ে আছে। ডায়াবেটিক সমিতির ভাবমূর্তি জড়িয়ে আছে এবং ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর মতো সমাজের একটি বিশিষ্ট নাগরিকের ভাবমূর্তিও জড়িয়ে আছে। আসলে এ বিষয়টি অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, আমরা শুনেছি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিলো এবং তারা তদন্ত রিপোর্টও দিয়েছে। আবার সেই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর সদস্য পদ বাতিলও করা হয়েছে। তবে, এ অভিযোগটির সাথে আমার বাবার ভাবমূর্তি জড়িত থাকলেও তদন্ত কমিটি আমাদের পরিবারের কাউকে কখনো ডাকেনি। তারা কিভাবে সনাক্ত করেছেন যে ওই লেখা আমার বাবার না। তাছাড়া তদন্ত কমিটি কি রিপোর্ট দিয়েছে তা আমরা জানি না।

এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান এড. শওকত আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অনেকটা পাশ কাটিয়ে যান এবং বলেন, তদন্তে আমরা যা পেয়েছি তদন্ত রিপোর্টে তা উল্লেখ করেছি। এটা বলার এখতিয়ার আমার নাই। আপনারা নির্বাচন কমিশন বা বর্তমান সেক্রেটারীর সাথে যোগাযোগ করেন।

বর্তমান সেক্রেটারী দেলোয়ার হোসেন চুন্নুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আগামী ২ তারিখে অফিসে আসলে তিনি সকল কাগজপত্র সাথে নিয়ে সরাসরি কথা বলবেন। যদিও এর আগে তিনি ১ তারিখে সকল কাগজপত্রসহ কথা বলতে সম্মত হয়েছিলেন।

সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার শাহ ফতেহ উল্লাহ সেলিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ঢাকা থাকি এবং বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকি। তাই সময় দিতে না পারার কারণে আমি মূলত পদত্যাগ করেছি।

ডা. শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, খসড়া ভোটার তালিকা দেয়ার আগেই এ ওয়াই এম হাশমত উল্লাহ সাহেব ডা. শাহনেওয়াজের সদস্য পদ নিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ আমাকে দিয়েছিলো। তবে, যেহেতু তখনো ভোটার তালিকা চুড়ান্ত হয়নি তাই আমি বলেছিলাম চুড়ান্ত ভোটার তালিকার আগে আমার কিছু করার নেই। তার কিছুদিন পরই ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে না পারায় আমি পদত্যাগ করে চলে আসি।

এ সকল বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এ, ওয়াই, এম হাশমত উল্লাহ বলেন, এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন আমাদের সেক্রেটারী সাহেব। আপনি নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা সময়ে ডা. শাহনেওয়াজ কিভাবে সভাপতি হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তখন তার কোনো অপনেন্ট ছিলো না তাই এগুলো দেখা হয় নাই।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।