হাইব্রীডদের চাপে কোনঠাসা ত্যাগী নেতাকর্মীরা

106

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

নারায়ণগঞ্জে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দল থেকে আসা হাইব্রীড নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সারা জেলা। হাইব্রীড নেতাকর্মীরা অদৃশ্য শক্তির কারণে বেশ দাপটের সাথে নানা অপকর্ম করে আওয়ামীলীগের সুনাম নষ্ট করছে বলে অভিযোগ ত্যাগী নেতাকর্মীদের। একইসাথে আওয়ামীলীগের নাম বিক্রি করে নানা কায়দায় নিজেদের আখের গোছানোর অভিযোগও উঠেছে হাইব্রীড নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে জেলা ও মহানগরে ত্যাগী নেতাকর্মীদের অসন্তোষ বেশ পুরোনো। কারণ এই অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে চরম কোণঠাসায় ত্যাগী নেতাকর্মীরা। ত্যাগী নেতাকর্মীদের মতে, অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান, জনপ্রিতিনিধি ও বড় বড় নেতাদের সখ্যতা বেশি। তাদের কান কথায় ত্যাগী নেতাকর্মীদের প্রতি মুখ ভার দলের স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের।

শুধু তাই নয়, হাইব্রীডদের নানা অপকৌশলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অবস্থা এমন যে, অনুপ্রবেশকারীরাই এখন শীর্ষ নেতাদের শুভাকাক্সক্ষী। যারা প্রশ্রয় পেয়ে দলের নাম ভাঙিয়ে দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, বালু পাচার, টেন্ডার বাণিজ্য, দলীয় পদ ও মনোনয়ন বাণিজ্যসহ এমন কোন অপরাধ নেই করছে না। এদের অপকর্মে সাধারণ মানুষের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন কমছে। দলীয় প্রতীক ও নাম বিক্রি না করলে সাধারণ মানুষ এদের চৌকিদার হিসাবেও নির্বাচিত করবে না। ফলে দলের এই হালে হতাশ এখন প্রকৃত নেতাকর্মীরা।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার অনুপ্রবেশকারীদের কাউয়া, কোকিল, উইপোকা, ছারপোকাদের দল ও পদপদবি থেকে বহিষ্কারের কথা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মুখে শুনা গেছে এবং এ লক্ষ্যে তালিকা তৈরির বিষয়টিও সামনে এসেছে। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে তেমন কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, মন্ত্রী-এমপি-মেয়র, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এখন সিনেমার নায়ক-নায়িকার চেয়েও বড় অভিনেতা। অনুপ্রবেশকারীরা তাদের সাইড অ্যাক্টরস। যাদের ছাড়া অভিনয়মঞ্চ মলিন। তাল-লয়-সুর ঠিক রাখতে এদের অনুপ্রবেশ। আর প্রকৃত দলীয় কর্মীরা এখন শুধুই দর্শক। যারা এসব দেখে দেখে শুধু কাঁদবে আর হাসবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বলেন, পুরোদেশের মতো নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগেও কাউয়া-কোকিল, উইপোকা-ছারপোকার অনুপ্রবেশের কথা বলা হলেও কয়েকটি উপজেলায় অসংখ্য তেলাপোকার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এদের কথা কারও মুখে শুনা যায়নি। ফলে আমরা দলের প্রকৃত কর্মীরা হতাশ।

জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে ত্যাগী নেতাকর্মীদের বেশী ক্ষুব্ধ। এরমধ্যে নেতাকর্মীরা জানান, ২০০৯ সালের পর প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এমনকি ৮০-র দশকের তুখোড় অনেক ছাত্রনেতাসহ শতাধিক ত্যাগী নেতাকর্মী দলীয় পদ-পদবি থেকেও বঞ্চিত।

ছাত্রনেতারা জানান, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনে বিএনপি ছাত্রদলের কর্মীরাও পদ-পদবি পেয়েছেন। তবে বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়া অনুপ্রবেশকারীরা দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, বালু পাচার, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন।

প্রবীন এক রাজনীতিবীদ বলেন, বর্তমান সরকার পরপর তিনবার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের কিছু সুবিধাবাদী নেতাকর্মীর ছত্রছায়ায় জামায়াত-বিএনপির অসংখ্য অনুসারী দলে ঢুকে পড়েছে। তারা দলের নাম ভাঙিয়ে টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, সরকারি-বেসরকারি জমি দখল, খাল দখল, চাঁদাবাজির মতো অপকর্মে জড়িয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে চলেছে।

এদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের থানা, ইউনিয়নসহ বিভিন্ন কমিটির পদ-পদবিতে আছেন। আবার কেউ দলের কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী-মেয়র, চেয়ারম্যান-মেম্বার ও প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় মোটাতাজা হচ্ছেন। স্থানীয় পর্যায়ের এদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন না করায় নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তবে আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মনে করেন, অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে দলের দুর্দিনের ত্যাগী, নির্যাতিত ও ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সমন্বয় করলে পুনরায় প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাবে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে।

একইসঙ্গে দলের পদ-পদবীতে থাকা কতিপয় দুর্নীতিবাজ নেতার ছত্রছায়ায় বিভিন্ন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারীদেরও চিহ্নিত করে বহিষ্কারের দাবি করেছেন তারা। পাশাপাশি ত্যাগী, নির্যাতিত, তরুণ, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব বিবেচনায় নতুন নতুন কমিটি গঠনের দাবি করেছেন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা।

দলের তৃণমূল পর্যায়ের অসংখ্য নির্যাতিত নেতাকর্মীরা জানান, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তৎকালীন বিএনপি ও জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্যাডারদের হাতে তারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নৌকা মার্কার সমর্থক হওয়ায় সে সময় বিরোধী জোটের নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের তেমন কোন দুঃখ ছিলনা। কিন্তু পর পর তিনবার দল ক্ষমতায় থাকলেও উড়ে এসে জুড়ে বসা কতিপয় নেতার একক আধিপত্যের কারণে তাদের (দলের প্রকৃত নেতাকর্মী) শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন থেকে দলের মধ্যে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।

যে কারণে আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতাকর্মীদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক কর্মকান্ডগুলোতে অংশগ্রহণ করা ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের দুর্দিনের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীরা ক্ষমতার তিনটি আমলেই অনুপ্রবেশকারীদের প্রভাবে কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পরিচালনা কমিটির পদ-পদবী থেকে শুরু করে দলের সকল পর্যায়ে অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে পরেছেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

দলে অনুপ্রবেশকারীদের সুসময়ে পেলেও দুঃসময়ে পাওয়া যাবে না। এদের জায়গা না দেয়ার আহবান সকলের। আগামী নির্বাচন উপলক্ষ্যে দলকে শক্তিশালী করতে হলে কোনো মাদকাসক্ত, চাঁদাবাজ, মাস্তান ও দুর্নীতিবাজদের ঠাঁই না দিয়ে সৎ ও যোগ্যদের নেতৃত্বে আনার দাবী তৃণমূল নেতাকর্মীদের।