রাজনীতিতে স্লোাগানটির জনক শামীম ওসমান...

শুরু হয়ে গেছে খেলা

102
শুরু হয়ে গেছে খেলা

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

“খেলা হবে” রাজনীতিতে এই স্লোাগানটির জনক শামীম ওসমান। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে এটি আবার ফিরে এসেছে বাংলাদেশে।নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বলছিলেন, ডিসেম্বরে আসল খেলা হবে। ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছিলেন ওসমান পরিবারের সবচেয়ে আলোচিত এ মানুষটি।

তবে নারায়ণগঞ্জের ওই বক্তব্যেই কথা শেষ করেননি কাদের। গত বুধবার বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, ডিসেম্বরে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাবেন, একটু অপেক্ষা করুন। তো খেলা হওয়া নিয়ে ক’দিন আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কথা হয়ে গেল। সে খেলা কি মাঠে গড়িয়েছে? সম্ভবত, কিছুটা।

রাজনীতি আবার ফিরেছে ময়দানে, সমাবেশে জনস্রোত। পায়ে হেঁটে লম্বা পথ অতিক্রম করে আসছেন মানুষ। এমনকি কেউ কেউ ৫০-৬০ কিলোমিটারও হেঁটে আসছেন। রাতের ভোটের আলোচনা এখনো মিইয়ে যায়নি। এরই মধ্যে রাতের সমাবেশও দেখছে মানুষ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা। জনস্রোত দেখে আশাবাদী বিএনপি। বসে নেই আওয়ামী লীগও। সভা-সম্মেলন, পাল্টা শোডাউন শুরু করেছে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি।

আলোচনাটা চলছে রাজনীতি নিয়ে। তবে কে না জানে এখনকার প্রধান ইস্যু রাজনীতি নয় অর্থনীতি। যা নিয়ে প্রতিদিনই উদ্বেগ বাড়ছে এবং সেটা খুব দ্রুত। এমনকি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তো রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। কঠিন এক বাস্তবতার কথাই তুলে ধরেছেন তিনি।

সরকারের ভেতরে-বাইরে এখনো তা নিয়ে চলছে চাপান-উতোর। ক্ষমতাসীন দলের ভেতর তৈরি হয়েছে এক ধরনের অস্বস্তি। আলোর উৎসব রীতিমতো অন্ধকার তৈরি করেছে। লোডশেডিং নতুন নতুন রেকর্ড করছে। অথচ আশ্বস্ত করা হয়েছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্প কারখানার। রিজার্ভ কমছে দ্রুত। সুখবর নেই অন্য খাতেও। এই যখন অবস্থা তখন আইএমএফ’র একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায়। আলোচনায় এসেছে সংস্কার এবং রিজার্ভের পরিমাণ। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই সরকারগুলো আইএমএফ’র শরণাপন্ন হয়।

তবে, এ ধরনের ঋণ রাজনৈতিক সরকারগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জিংও বটে। কারণ আইএমএফ অনেক শর্ত দিয়ে থাকে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণেই কি বর্তমান পরিস্থিতি? অনেক অর্থনীতিবিদই এ বক্তব্য মানতে নারাজ। ফেসবুকে অনেকে এ নিয়ে ঠাট্টা করে আগেই লিখেছেন।

খ্যাতিমান রাজনীতিবীদ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. সলিমুল্লাহ খানও এখন এ প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, মনে হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সব খরচ বাংলাদেশ বহন করছে!

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আল্টিমেটাম ও ডেডলাইনের ইতিহাস পুরনো। বিশেষ করে বিএনপি জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের ৩০শে এপ্রিলের ট্রাম্প কার্ডতো রীতিমতো ঝড় তুলেছিল। যদিও আদতে শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি।

এবার ডিসেম্বরে আরও নির্দিষ্ট করে বললে ১০ই ডিসেম্বরের আলোচনার সূত্রপাত করেন বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান। ঢাকায় এক সমাবেশে তিনি বলেন, ১০ই ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। শুরুতে এটিকে মনে করা হয়েছিল কথার কথা। তবে দ্রুতই এ নিয়ে রাজনীতিতে শুরু হয় বাহাস, যা এখনো চলমান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৪-১৫ মাসের মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে নির্বাচনের গতি প্রকৃতি এখনো স্পষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর একটি অংশের চাওয়া যদিও এরইমধ্যে স্পষ্ট।

জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্র আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে ফিরে এসেছে। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান নিচ্ছে। তার মিত্র দেশগুলোর ভূমিকাও একই। বাংলাদেশে অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে এই অংশ জোরালো অবস্থান নিয়েছে। তবে গত দুইবারও তাদের একই অবস্থান ছিল। এবারের অবস্থান একইরকম না ভিন্ন তা দেখতে অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ঢাকায় সক্রিয় চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। নির্বাচনের মতো বিষয়কে চীন যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে। ভারতের অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভোট যত ঘনিয়ে আসবে ততো তাদের অবস্থান খোলাসা হবে।

এই দৃশ্যপট সামনে রেখেই এবার আন্দোলনে নেমেছে বিএনপি। এই আন্দোলন যেকোনো মূল্যে সহিংসতামুক্ত রাখতে চায় দলটি। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, দল হিসেবেও বিএনপি অনেকটা পাল্টে গেছে। সাবেক আমলা, ব্যবসায়ীদের বিপরীতে বিএনপিতে উত্থান ঘটেছে ১৬ বছর ধরে ত্যাগ স্বীকার করা কর্মীদের। যেকোনো মূল্যে তারা সফল আন্দোলন চায়। বিএনপি’র সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে তারাই সবচেয়ে সক্রিয়। এই কর্মীদের ওপর ভর করেই বিএনপি এবারের আন্দোলনকে ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে চায়।

ডিসেম্বরেই আন্দোলন চূড়ান্ত কোনো পরিণতি পাবে বিএনপি’র অতি আশাবাদী নেতারাও তা মনে করেন না। তবে তারা মনে করেন, এবারের আন্দোলনটি তাদের জন্য ডু আর ডাই ম্যাচ। আর এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়ে প্রবেশ করবে ডিসেম্বরে। বিরোধী রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টির পরীক্ষাও হবে এ সময়। কারণ যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা হতে পারে ডিসেম্বরে। সেক্ষেত্রে বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত দলগুলো আসলে কী ভূমিকা নেয় তা হবে দেখার।

জাতীয় পার্টির গন্তব্য হবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদের পথ এরইমধ্যে আলাদা হয়ে গেছে। তবুও দলটির যথেষ্ট মর্যাদা এখনো রয়েছে প্রধান দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপির কাছে।

জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে দুই ধরনের আলোচনা রয়েছে। নিবন্ধন চাওয়া বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি জামায়াতের সহযোগী এমন আলোচনা জোরদার হয়েছে। বলা হচ্ছে এটি সমঝোতার অংশ। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় থাকবে। কমিটিতে জায়গা না পাওয়া কিংবা গুরুত্ব হারানো বিএনপি নেতাদের বিষয়ও আলোচিত হচ্ছে।

বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা এক বিএনপি নেতা নতুন দল গঠনের চেষ্টা করছেন এমন খবরও রয়েছে। এসব সমীকরণ মাথায় রেখেই ১০ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি। দেয়া হতে পারে আল্টিমেটাম। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির ঘোষণাও আসতে পারে এ সমাবেশ থেকে। এর আগে-পরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন বিএনপি’র এমপিরা। ঘোষণা করা হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা। বিএনপি’র কাছে এরইমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে ঢাকার সমাবেশ কর্মসূচি নির্বিঘ্ন হবে না। তবে যেকোনো মূল্যে ১০ই ডিসেম্বর স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। এজন্য আগে থেকেই কৌশলে ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীরাও ঢাকায় অবস্থান নিতে পারেন।

সাম্প্রতিক বিএনপি’র সমাবেশগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এক ধরনের চাপও তৈরি করেছে। বিএনপি’র জনসমাবেশে উপস্থিতি কমাতে কিছু কৌশলী পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদিও সমাবেশগুলোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। লোকসমাগমও হচ্ছে ব্যাপক। বিএনপি’র সমাবেশের বিপরীতে বড় শোডাউনের কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ডিসেম্বরে ঢাকাতে বড় ধরনের সমাবেশ করতে চায় দলটি। বিএনপি’র থেকে বেশি উপস্থিতি দেখানোটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে দলটি। যদিও আজ থেকেই ঢাকায় শোডাউন শুরু করছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশের মাঠে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আজ। গতকাল ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনসমাগম কাকে বলে তা শনিবার থেকে বিএনপিকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে যুবলীগও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. সাব্বির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, সাধারণত শীতকালে দেশে রাজনীতির মাঠ একটু গরম হয়েই থাকে। সামনে নির্বাচন, এ নিয়ে বড় দলগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম সাজাচ্ছে। বিএনপি ইতিমধ্যে বড় কয়েকটি সমাবেশ করে সফলতা পেয়েছে। এই রাজনৈতিক কার্যক্রম সামনে আরও বৃদ্ধিপাবে। তবে আমার ধারণা ক্ষমতাসীন দল কিছুটা নমনীয় আচরণ করবে। হয়তো মামলা মোকদ্দমা বৃদ্ধি পাবে কিন্তু মাঠে প্রতিহত করার বিষয়টি কমে যাবে। কারণ অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে সরকার চাইবে না বিদেশি বিনিয়োগের ওপর কোনোভাবে প্রভাব পড়ুক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি লাগামছাড়া হয়ে যায়নি। তবে অনেক সময় ভাষাগত আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ, বাক সংযমের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচনের বাকি এখনো ১৪ মাস। এখন যে ধরনের কথার লড়াই চলছে, তা সামনের দিনে একই রকম থাকবে কিনা সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। চিত্র অনেক পাল্টাবে, পাল্টাতে বাধ্য। কথার লড়াইয়ের মাঝেও বিএনপি কয়েকটি জনসভা করেছে। এটা সব দিক থেকে ভালো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সামনে আমার মনে হয় নানারকমের দিকে দেয়া-নেয়ার কিছু বিষয় আসবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ডিসেম্বর নিয়ে যে আলোচনা চলছে এটা গতানুগতিক। এটা শব্দের লড়াই। অর্থনৈতিক সংকটটাই এখন প্রধান। মানুষ জেরবার।

শেষ কথা: ইতিহাসে এটা দেখা গেছে, কখনো কখনো অর্থনীতিই রাজনীতির গতিপথ ঠিক করে দিয়েছে। কী ঘটবে বাংলাদেশে। নানা আলোচনা। জাতি যখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি তখন রাজনীতি পুরোমাত্রায় মাঠে গড়ানোর অপেক্ষায়। ডিসেম্বরে ট্রাইবেকারের সম্ভাবনা নেই। তবে নিশ্চিতভাবেই ম্যাচ শুরু হচ্ছে। (সূত্র-দৈনিক মানবজমিন)