শীর্ষ ঋন খেলাপী বজলু এফবিসিসিআই এর পরিচালক, নানা প্রশ্ন

220

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

দেশের শীর্ষ ঋন খেলাপীদের অন্যতম বজলুর রহমান বজলু আবারও বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। তাই তাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। কেননা বজলুকে দেশের শীর্ষ ঋন খেলাপী হিসাবে চিহ্নিত করেছে বর্তমান সরকার।

মহান জাতীয় সংসদে যে বিশ জন শীর্ষ ঋন খেলাপীর নাম ঘোষনা করা হয়েছে তাদের মাঝে দশ নম্বরে ছিলো তার নাম। ফলে তার মতো এমন একজন শীর্ষ ঋন খেলাপী কিভাবে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক নির্বাচিত হন সেই প্রশ্ন উঠেছে জোরালো ভাবে। কেননা আইএমএফ এর কাছ থেকে সরকার ঋন নেয়ার সময় এই সংস্থাটির প্রধান একটি শর্ত ছিলো অবিলম্বে খেলাপী ঋন আদায় করার। কিন্তু ঋন আদায় করাতো দূরের কথা উল্টো নতুন করে বুক ফুলিয়ে ব্যাবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের আসনে আসিন হয়েছেন বজলু। ফলে খোদ ব্যবসায়ী মহলেই এ বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

প্রসঙ্গত সরকার প্রথমে দেশের শীর্ষ ঋন খেলাপীদের তালিকা জাতীয় সংসদে প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় দশ নম্বরে রয়েছে সোনারগাঁওয়ের এই বজলুর নাম। পরে বজলু পরিবারের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়েছে। তবে তবে আরো আগেই দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমে এই ঋন খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জোরালো দাবি তোলা হয়েছে। এদের পাসপোর্ট জব্দ করার এবং প্রয়োজনে গ্রেফতার করার দাবিও জোরালো হচ্ছে।

এছাড়া দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় অর্থনীতিবিদ মঈনুল ইসলাম কলাম লিখে জানিয়েছেন, ঋন খেলাপিরা খেলাপি ঋনের বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচার হওয়া অর্থ কখনোই ফেরত আসবে না। পাচার হওয়া অর্থে বিদেশে বাড়ি কিনেছে পাচারকারীরা। সম্পত্তি কিনেছে। পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে অনেকেই এখন ওই সব দেশে আসা-যাওয়া করছে। একটা পর্যায়ে তারাও চলে যাবে। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট তার নেপথ্যে রয়েছে খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার বেড়ে যাওয়া। দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের অর্থ পাচার বেড়েছে বলে এখন বৈধপথে প্রবাসী আয়ও কমছে। খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ছে। রিজার্ভ দ্রুত কমছে। এখনই খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি ও হুন্ডি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া না হলে আগামী এক বছরে দেশ চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য যে প্রকাশ করা হচ্ছে না তা বহুবার বলেছি।

গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার যে হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তা মোটেও সঠিক নয়। অবলোপন করা ঋণ, আদালতে মামলা চলছে এমন ঋণ এবং বারবার পুনঃ তফসিল করা ঋণের হিসাব খেলাপি ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সব মিলিয়ে দেখলে বর্তমানে খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অবলোপন করা ঋণ বাদে অন্য সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে হিসাব দিয়েছে। অবলোপন করা ঋণসহ তা দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ কোটি টাকায়। দুই বছরে তা বেড়ে চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর অর্থ হলো, ব্যাংক খাতে মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি খেলাপি হয়ে গেছে। এর বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। অর্থ পাচার যে বাড়ছে, তার বড় প্রতিফলন রয়েছে বৈধপথে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার তথ্যে।

সরকারের সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগই বলছে, এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। খেলাপি ঋণ বা দুর্নীতির টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার প্রভাব পড়েছে রিজার্ভে। রিজার্ভের দ্রুত পতন হচ্ছে। সঠিক হিসাব করা হলে এখন রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে দাঁড়াবে। তাহলে এক বছরের কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভে নেই। এটা গুরুতর সংকট। এর অর্থ হলো, বিপজ্জনক ধারায় বাংলাদেশ পড়ে গেছে।

অর্থ পাচার অনেক বাড়লেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করছে না। উল্টো এবারের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। চার মাসে একজনও অর্থ ফেরত আনেননি। সরকারের এ সিদ্ধান্ত যে ইতিবাচক ফল দেবে না, তখনই আমরা বলেছি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সরকার পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত। যেসব দেশে বেশি পাচার হয়েছে এমন আটটি দেশেও যদি আটটি দল পাঠানো হতো, তাহলে পাচার হওয়া অর্থের তথ্য পাওয়া যেত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো রকমের কোনো তৎপরতাও দেখছি না। দুর্নীতি দমন না করলে পাচার ঠেকানো যাবে না। অর্থ পাচার ঠেকাতে না পারলে খোলাবাজারে ডলারের যে চাহিদা তাও কমবে না। হুন্ডি ব্যবস্থা যে চাঙা হচ্ছে, সেটিও ঠেকানো যাবে না। এমনকি আইএমএফ ঋণ পেলেও রিজার্ভের পতন থামবে বলে মনে হয় না। খেলাপি ঋণকে প্রশ্রয় দেওয়া, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া শামিল। এগুলো থেকে সরকার সরে না এলে বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি মিলবে না।

মূলত এভাবেই এখন বজলু সহ দেশের শীর্ষ ঋন খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। এছাড়া আইএমএফ দেশের ঋন ব্যবস্থা সহ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শৃংখলা ফেরাতে সরকারকে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহন করার কথা বলেছে সরকার তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবে বলে ধারনা করা হচ্ছিলো। অন্যথায়, মুখ ফিরিয়ে নেবে আইএমএফ সহ আন্তর্জাতিক ঋন দাতা সংস্থাগুলো। তাই এতোকাল বজলু গং যেভাবে জণগণের আমানতের টাকা ঋন হিসাবে নিয়ে যা খুশী তাই করে বেরিয়েছেন এখন আর সেটা সম্ভব হবে না বলে মনে করা হচ্ছিলো। বরং ঋন পরিশোধ করতে না পারলে তিনি যে কঠোর ব্যবস্থার মুখোমুখি হবেন অনেকেরই ধারনা ছিলো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।