চার ব্যাংকে তার খেলাপি ঋনের পরিমান ১১শ কোটি টাকা...

শীর্ষ ঋন খেলাপি বজলুর বিআর স্পিনিং মিলের বিরুদ্ধে এবার দৈনিক সমকালের রিপোর্ট

137

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ :

বিপুল অংকের টাকা ঋন খেলাপির দায়ে আবারও সংবাদ শিরোনাম হলেন সেই বজলুর রহমার বজলু। তিনি বিআর স্পিনিং মিলের মালিক। ঋন খেলাপির দায়ে তার প্রতিষ্ঠান বার বার সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে।

গত ২৫ জুন মঙ্গলবার দৈনিক সমকালের প্রধান শিরোনামে আবারো সমালোচিত হয়েছে এই বিআর স্পিনিং মিল। রিপোর্টটির শিরোনাম ছিলো “শীর্ষ ২০ ঋন খেলাপির কাছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা” এই রিপোর্টে বলা হয়েছে বিআর স্পিনিং এর চার ব্যাংকে প্রায় ১১শ কোটি টাকার ঋন রয়েছে। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির ঋনের পরিমান ৫৭৪ কোটি টাকা।

কিন্তু মজার বিষয় হলো এই প্রতিষ্ঠানের মালিক বজলুর রহমান ওরফে বজলু এই বিপুল অংকের টাকা ঋন খেলাপি হয়েও জীবন কাটাচ্ছেন মজমাস্তি করে। ভোগ বিলাশেই কাটছে তার জীবন। শুধু তাই নয় তিনি তার নিজের এলাকা সোনারগাঁয়ে বেশ নোংড়া ধরনের ভিলেজ পলিটিক্সে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্যাংক গুলোর টাকা পরিশোধ করতে না পারলেও গ্রামে গিয়ে টাউট বাটপার শ্রেনীর কিছু লোককে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন তিনি। আর এই টাউটদের সহায়তায় সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে চলেছেন। তাকে দেখলে মনেই হয়না তিনি এমন বড় আকারের একজন ঋন খেলাপি।

দৈনিক প্রথম আলো, সমকাল এবং বনিক বার্তা সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ঋন খেলাপির বিরুদ্ধে একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশ হলেও তার মাঝে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো লেশ মাত্র নেই। জাতীয় সংসদে দেশের দশ শীর্ষ ঋন খেলাপির যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিলো সেই তালিকায়ও বজলুর বিআর স্পিনিং মিল ছিলো।

এছাড়াও তাদের পারিবারিক মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সম্পত্তি এরই মাঝে নিলামে উঠতে শুরু করেছে। তাই সোনারগাঁবাসীর প্রশ্ন এমন একজন ঋন খেলাপি কিভাবে ঋন পরিশোধ না করে দেশে বসেই বিলাসী জীবনযাপন করছে এবং নিজের এলাকায় নোংরা ভিলেজ পলিটিক্স করছে?

দৈনিক সমকালে প্রকাশিত রিপোর্টটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো, শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ তালিকায় ব্যাংক খাতের ঋণ জালিয়াতিতে আলোচিত সাদ মুসা গ্রুপ, এননটেক্স গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, মাইশা গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপসহ বিভিন্ন গ্রুপের নাম রয়েছে। শীর্ষ খেলাপিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি মালিকানার জনতা এবং বেসরকারি মালিকানার ন্যাশনাল ব্যাংক। দুটি ব্যাংকের অবস্থা আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে।

এদিকে ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে বলে সংসদকে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। গতকাল আওয়ামী লীগ দলীয় সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ফরিদা ইয়াসমিনের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান। গত বছরের জানুয়ারিতে সংসদে ব্যাংক খাতের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওই তালিকায় যাদের নাম ছিল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা এখনও শীর্ষ খেলাপির তালিকায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল সংসদের বৈঠক শুরু হলে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপন করা হয়। ফরিদা ইয়াসমিন তাঁর প্রশ্নে শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগদলীয় এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের অপর এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগের কথা জানান।

গত বছরের ২৪ জানুয়ারি আ হ ম মুস্তফা কামাল শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকা সংসদে তুলে ধরেন। ওই তালিকার বেশির ভাগই ছিল বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংকের গ্রাহক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের সংসদে যাদের নাম এসেছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনও শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় তারাই রয়েছে। তবে গত বছরের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় জনতা ব্যাংকের বড় গ্রাহক এননটেক্সের নাম ছিল না। ব্যাংকটির ২০২৩ সালভিত্তিক এক প্রতিবেদনে এননটেক্সের ৭ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা খেলাপি দেখানো হয়েছে। জনতা ব্যাংকে রতনপুর গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা ঋণের সবই খেলাপি দেখানো হয়েছে। গত বছর শীর্ষ খেলাপির তালিকায় এই গ্রুপের নাম ছিল না।

নানা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ায় আলোচিত সাদ মুসা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি দেখানো হয়েছিল গত বছরের তালিকায়। এর মধ্যে সাদ মুসা ফেব্রিক্সের কাছে এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। আর তার বেনামি কোম্পানি রেডিয়াম কম্পোজিটের কাছে একই ব্যাংকের পাওনা ৭৫৪ কোটি টাকা।

সমকালের সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাদ মুসা গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ মহসিনের ২৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।

গত বছরের খেলাপি তালিকায় শীর্ষে ছিল ঢাকার মিরপুরের প্রয়াত আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সিএলসি পাওয়ার। তাঁর ঋণের সবই বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকে মাইশা গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। অনেক আগে থেকে ঋণ পরিশোধ না করলেও আসলামুল হক জীবিত থাকা অবস্থায় নানা উপায়ে এসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হতো।

ব্যাংকাররা জানান, শুধু আসলামুল হক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ শোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থেকেছেন, তেমন নয়। অনেকেই ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপিমুক্ত থাকার নজির রয়েছে। অনেকেই বেনামি ঋণের টাকায় আগের ঋণ সমন্বয় করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। আবার ঋণ পুনঃতপশিল, পুনর্গঠন, নবায়ন কিংবা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে কাগজকলমে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এসব নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। যে কারণে শীর্ষ ঋণখেলাপি কিংবা ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসে না। কেননা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে প্রভাবশালীরা নানা উপায়ে ঋণ নিয়মিত দেখান। আবার যেসব তথ্য প্রকাশিত হয় সেখানে গ্রুপের পুরো ঋণ না দেখিয়ে কেবল আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠান ধরে ধরে তথ্য দেওয়া হয়। যে কারণে শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছে ব্যাংকের প্রকৃত পাওনা বোঝা যায় না।

শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংকের আলোচিত ঋণখেলাপি ক্রিসেন্ট গ্রুপ। গ্রুপটির কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট লেদারের ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা, রিম্যাক্স ফুটওয়্যারের ১ হাজার ১৩৪ কোটি এবং লেক্সকো লিমিটেডের ৬৫৫ কোটি টাকা।

গত বছর তালিকায় থাকা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকে রয়েছে ৯৭৫ কোটি টাকা। গত বছরের তালিকায় নাম থাকা বিআর স্পিনিংয়ের চার ব্যাংকে প্রায় ১১শ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ ৫৭৪ কোটি টাকা।

চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী এসএ গ্রুপের কর্ণধার সাহাবুদ্দীন আলমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসএ অয়েল ও সামান্নাজ সুপার অয়েলের খেলাপি ঋণ রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকে রয়েছে ৩৮৫ কোটি টাকা। মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজির কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পাওনা ৬৪৭ কোটি টাকা ঋণের সবই খেলাপি। ন্যাশনাল ব্যাংকে এহসান স্টিল রি-রোলিং মিলের ৬১৯ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে।

জাতীয় সংসদে গত বছর প্রকাশিত তালিকায় নাম উঠে আসা রাইজিং স্টিলের ১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৯০ কোটি টাকা ছিল খেলাপি। চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স লিমিটেডের খেলাপি ছিল ৯৬৬ কোটি টাকা। দেশের সুপরিচিত আসবাব নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান অটোবির কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেমের ৮১১ কোটি টাকা ঋণের সবই ছিল খেলাপি। আশিয়ান এডুকেশন লিমিটেডের ৬৫৩ কোটি টাকা ঋণের ৬৩৬ কোটি, এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলের ৮৮৯ কোটি টাকা ঋণের ৬৩০ কোটি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্সের ৮৭৩ কোটি টাকা ঋণের ৬২৩ কোটি এবং সিদ্দিকী ট্রেডার্সের ৬৭১ কোটি টাকা ঋণের ৫৪১ কোটি টাকা ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ৫০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত মেনে ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে এখনকার মতো নীতি-সহায়তা রাখা যাবে না।

গতকাল আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের অপর এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেঙ্কারি বন্ধে খেলাপি ঋণ গ্রহীতা ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন নিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে খেলাপি ঋণ গ্রহীতা ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে এক খাতের নামে ঋণ নিয়ে যেন অন্য খাতে ব্যবহার না হয় এবং অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়, তা নিয়মিত তদারকির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।