শারীরিক ও মানষিক ভাবে নির্মম নির্যাতনের পরেও তিনি ছিলেন আপোষহীন

51

নিজস্ব প্রতিবিদেক :

বেগম খালেদা জিয়া। একাধারে ছিলেন  ফার্স্টলেডি ও বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। টানা ৪৫ বছর ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন। গৃহবধূ থেকে আসেন রাজনীতিতে। ৯ বছর স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসেন। এরশাদের পতনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বসেন ক্ষমতার মসনদে। এরপর তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। দুবার দায়িত্ব পালন করেন বিরোধী দলীয় নেত্রীর। স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে আন্দোলন করে জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হন। হাসিনার পতনের পর দেশবাসীর পরম শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।  ক্ষণজন্মা এই নারীর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়ায়। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। আদি পৈতৃকনিবাস ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মজুমদার বাড়ী। বাবা ইস্কান্দর মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী।

খালেদা জিয়া পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুরের মিশন স্কুলে ভর্তি হন। এরপর তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। একই বছর তিনি জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে তিনি খালেদা জিয়া বা বেগম খালেদা জিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসের পূর্বে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। স্বামী বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যখন তার বিয়ে হয় তখন জিয়া ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআই-এর কর্মকর্তা রূপে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন।
১৯৬৫ সালে খালেদা জিয়া স্বামীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান) যান। ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত করাচিতে স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন জয়দেবপুর থাকার পর চট্টগ্রামে স্বামী কর্মহেতু স্থানান্তরিত হলে তার সঙ্গে সেখানে এবং চট্টগ্রামের ষোলশহর অঞ্চলে বসবাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৬ই মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ই জুন পর্যন্ত থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দুই সন্তানসহ তিনি মুক্তি পান। রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত বেগম জিয়া একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও রাজনীতিতে বেগম জিয়ার উপস্থিতি ছিল না।
১৯৮১ সালের ৩০মে একদল বিপথগামী সেনাদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের আহ্বানে তিনি ১৯৮২ সালের ৩রা জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। বেগম জিয়া এর বিরোধিতা করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১লা এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ই মে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচনে তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলত বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন: 
১৯৮৩ সালের বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। বেগম জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনেরো দলের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচির সূত্রপাত করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ শীর্ষক এক দফার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। তারপর পুনরায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উপক্রম হয়। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর অবিরাম, নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।
প্রধানমন্ত্রিত্বের ১ম মেয়াদকাল: 
১৯৯১ সালের ১৯শে মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া তার স্বামী জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তিনি ফার্স্ট লেডি ছিলেন। তার সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। ২রা এপ্রিল তিনি সংসদে সরকারের পক্ষে এই বিল উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে স্বপদে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল আনেন। ৬ই আগস্ট ১৯৯১ সালের সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিল পাশ হয়।
প্রধানমন্ত্রিত্বের ২য় মেয়াদকাল: 
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। যা পরবর্তীতে ৯৬ এর একদলীয় নির্বাচন হিসেবে গণ্য হয়। সকল বিরোধীদলের আপত্তির পর খালেদা জিয়া ও তার দল এই একক নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বয়কট করে। এই সংসদ মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। খালেদা জিয়া এই সংসদেরও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রবল গণআন্দোলন ও বহির্বিশ্বের চাপে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।
বিরোধীদলীয় নেতৃত্বের ১ম মেয়াদকাল: 
১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মোট ১১৬ আসনে জয়লাভ করে, যা সরকার গঠনে যথেষ্ট ছিল না। আওয়ামী লীগ মোট ১৪৭ আসন লাভ করে, তারা জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি সপ্তম সংসদে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর শাসনকালে সংসদে বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন ।
প্রধানমন্ত্রিত্বের ৩য় মেয়াদকাল: 
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির সাথে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া এই সংসদেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর এই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।
বিরোধীদলীয় নেতৃত্বের ২য় মেয়াদকাল:
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। মহাজোটের প্রায় ২৬০টি আসনের বিপরীতে চার দলীয় ঐক্যজোট মাত্র ৩২টি আসন লাভ করে।
হাসিনা বিরোধী আন্দোলন: 
২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসেই শেখ হাসিনা প্রথমেই খালেদা জিয়াকে স্বামীর ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করেন। চোখের সামনে তছনছ হতে দেখেন দীর্ঘ সংসারজীবনে তিলে তিলে গড়া ওই বাড়ির সব কিছু। ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ঢাকায় নিজের বাড়ি না থাকায় বাধ্য হয়ে উঠেন ছোটভাই শামীম ইস্কান্দারের বাসায়। সেখান থেকে উঠেন গুলশানের ভাড়া বাসায়। এরপর তার ওপর একে একে নেমে আসে ফ্যাসিবাদী হাসিনার সব আমানবিক নির্যাতনের খড়গ। তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করে দেয়ায় হাসিনার অধীনে একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে নামেন খালেদা জিয়া। ২০১৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র কর্মসূচিকে ঘিরে তাকে গুলশানের বাসায় কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়। বাসার সামনের দুই পাশে বালু ট্রাক দিয়ে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয় হাসিনার প্রশাসন। তখন সিনিয়র নেতা তো দূরের কথা তার নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে প্রবেশে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ওইদিন কর্মসূচিতে যেতে চাইলে খালেদা জিয়াকে বাড়ির ফটকেই আটকে দেয়া হয়। গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধা দেয়ায় হাসিনার ওপর ক্ষোভ উগড়ে দেন তিনি। বাড়ির ফটকে দাড়িয়েই হাসিনার অগণতান্ত্রিক আচরণের কড়া সমালোচনা করেন। এরপর ওই বাড়িতে একপ্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হয় তাকে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্জনের ডাক দেন খালেদা জিয়া। তার ডাকে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে ১৫৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী পায়নি হাসিনা। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ফের হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন খালেদা জিয়া। রাতে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বের হতে চাইলে তাকে আটকে দেয় পুলিশ। কার্যালয়ের সামনে দুই পাশে ফের বালুর ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। কার্যালয়ে তাকে অঘোষিতভাবে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। সেদিন কার্যালয়ে অবস্থান করা কর্মচারীদের খাবার নেয়াও বন্ধ করে দেয় পুলিশ। কেটে দেয়া হয় কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ। তীব্র সমালোচনার মুখে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে দিলেও অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি সাবেক প্রসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরীকেও। কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় হারান ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে। অবরুদ্ধ কার্যালয় থেকেই নাড়িছেঁড়া ধনকে শেষ বিদায় দেন। টানা ৯৩ দিন কার্যালয়ের দোতলার একটি কক্ষে অবরুদ্ধ অবস্থায় কাটান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী । এরপর তিনি লড়েন কথিত দুর্নীতির মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দুই মামলায় সাজা দিয়ে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের নির্জন কারাগারে তাকে পাঠানো হয়।
গ্রেপ্তার: 
১৯৮২ সালের ৩রা জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য রূপে দলে যোগ দেবার পর থেকে মোট পাঁচ বার তিনি গ্রেপ্তার হন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮শে নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩রা মে, ১৯৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর  গ্রেপ্তার হন।   তিনি ২০০৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে পুত্রসহ আটক হন। ২০০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তিনি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক বন্দি হওয়ার পর দীর্ঘ এক বছর সাতদিন কারাগারে অবস্থানকালে তার বিরুদ্ধে চলতে থাকা কোন অভিযোগেরই উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি এবং চলতে থাকা তদন্তে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে তার ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এরপরই তাকে বন্দি করে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫শে মার্চ তাকে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। এরপর থেকে তিনি গুলশানের ভাড়াবাসা ফিরোজায় উঠেন।
সেনানিবাসের বাসা ত্যাগ: 
২০১০ সালের ১৩ই নভেম্বর বেগম জিয়া তার ২৮ বছরের আবাসস্থল ছেড়ে যান। তিনি অভিযোগ করেন যে, তাকে বলপ্রয়োগে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি ত্যাগ করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে জিয়াউর রহমানের সাথে শহীদ মইনুল সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে ওঠেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে ১২ই জুন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার সেনানিবাসের ওই বাড়িটি খালেদার নামে বরাদ্দ দেন। ওই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলে তিনি গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডের এক নম্বর বাড়ি ফিরোজায় উঠেন।
অসুস্থতা: 
৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়া তার মেরুদণ্ড, ঘাড়, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা ছিল। ২০২১ সালের এপ্রিলে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে কয়েকবার নানা অসুস্থতার কারণে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। গত বছরের জুনে বুকে ব্যথা অনুভব করলে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ই জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। দীর্ঘ চার মাস পর ৬ই মে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেন। গত ২৩শে নভেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।