নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:
নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়ক, সিরাজদ্দৌলা সড়ক, সলিমুল্লাহ সড়ক, শায়েস্তাখান সড়ক, চেম্বার রোড, ২নং রেল গেইট, ১নং রেল গেইট, ডিআইটি, শেখ রাসেল পার্কের সামনের সড়কসহ প্রতিটি সড়কের ফুটপাতে দোকানপাট বসিয়েছে হকাররা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ ব্যাপারে নিস্ক্রিয় ভুমিকা পালন করছে বলে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, নগরীর সকল ফুটপাত বেদখলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুলিশকে দুষলেও তারা এ ব্যাপারে আঙুল তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে অসাধু কিছু পুলিশ সদস্য সামান্য উৎকোচ নিলেও রাজনৈতিক নেতারাই মূলত তাদের সেখানে দোকান বসানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হকাররা ফুটপাতে দোকান বসাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর ২নং রেল গেইট ও আশেপাশের এলাকায় ১৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরুজ্জামানের ছত্রছায়ায় থেকে ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে হকার নেতা পলাশ। নগরীর ১নং রেল গেইট ও আশেপাশের এলাকায় হকারদের নিয়ন্ত্রণ করে ১৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ^াসের সচিব আবুল কালাম। অসিত বরণ বিশ^াসের মিটিং মিছিলে যোগ দেয়ার শর্তে এখানে হকারদের বসতে দেয়া হয়েছে বলে জানায় হকারদের অনেকে।
অপরদিকে, নগরীর ডিআইটি এলাকায় হকার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকির খানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা জিয়াউর রহমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে। আরও জানা গেছে, মহানগর আওয়ামীলীগের এক নেতার ছত্রছায়ায় রহিম মুন্সী ও আসাদ চাষাড়ার ফুটপাত এবং সোহেল নিয়ন্ত্রণ করে পুরাতন কোর্ট রোড ও কালিরবাজারের ফুটপাত।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং ফুটপাতের হকারদের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। নগরীর চাষাড়া, কালিবাজার, পুরাতন কোর্ট, ২নং রেল গেইট ও ১নং রেল গেইটের ফুটপাতের হকাররা এ প্রতিবেদককে জানান, প্রতিদিন লাইনম্যানের হাতে আড়াই’শ থেকে ৩’শ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে নিজ নিজ এলাকার প্রভাবশালীরা নেয় ১’শ টাকা, থানা পুলিশ পায় একশ টাকা। বাকি ৫০ টাকা সিটি কর্পোরেশনের কতিপয় অসাধু কর্মচারীর। এসব সড়কে অন্তত ২ হাজার দোকান বসে এসব সড়কগুলোতে। সেখান থেকে প্রতিদিন ৫ লাখ টাকারও অধিক চাঁদা তোলা হয়।
কালিরবাজারে ফ্রেন্ডস মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শহরের অন্যতম বাণির্জিক এলাকা কালিরবাজারের মতো জায়গায় একটি রাস্তার সিংহভাগই হকাররা দখল করে নিয়েছে; ফুটপাতও বেদখল হয়ে গেছে। অথচ প্রশাসন ফুটপাত দখল মুক্ত করার বিষয়ে কখনোই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করছে না। হকারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রশাসনের ব্যর্থ কর্মকর্তাদের আগে সাজার আওতায় আনা জরুরি বলে মত দেন এই ব্যবসায়ী।
নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের খেলা চললেও মূলত প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এর নেপথ্যে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ রয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।
তাদের মতে, অবৈধ কর্মকান্ডে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা প্রমাণ করে তারা কোনো না কোনোভাবে এসবের সঙ্গে জড়িত। অবৈধ দখলদারদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারছে না বলেই ফুটপাতের একটি বড় অংশ হকারদের দখলে চলে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে। তবে অধিকাংশ সময়েই তারা নিরব থাকছে। সরকারের যেসব সংস্থা বা কার্যালয় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনলেই এসব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন পরিকল্পনাবিদরা।
হকার নেতারাও বলছেন, তাদের ঘাড়ে ভর করে পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা ফুটপাত দখল বাণিজ্য চালাচ্ছে। তারা হকারদের কাছ থেকে দৈনিক মোটা অংকের চাঁদা তুলছে। যার একটি অংশ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ চক্রের হাতে পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে।
নিজেদের পক্ষ নিয়ে তারা বলেন, আমরা হকাররা যতটা জায়গা দখল করে দোকান বসাচ্ছি, তার চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী দোকান মালিকদের দখলে রয়েছে। রাস্তাসংলগ্ন স্থায়ী দোকানিরা ফুটপাত দখল করে তাদের বিভিন্ন মালামাল রাখছে। অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট মালিক নিজেরা ফুটপাত দখল করছে এবং তাদের ক্রেতাদের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও করেছে। এ ছাড়া পার্কিংবিহীন বহুতল বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে আসা ব্যক্তিরা ফুটপাত দখল করে বিভিন্ন যানবাহন রাখছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতি: পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, আগের তুলনায় বর্তমানে নতুন করে আবার ফুটপাত দখল বেড়েছে। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক হকার ভ্যানে বিভিন্ন পণ্য সাজিয়ে রাস্তার পাশে বিক্রি করছে। এতে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। কমছে যানবাহনের গতি। হকারদের রাস্তা ও ফুটপাত দখলের পাল্লায় প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কেই প্রতিনিয়ত তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা।
নগরবাসীর অভিযোগ, নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাত দখল মুক্ত করতে সিটি কর্পোরেশন তথা নগরমাতা আইভীর চাপে রোজার আগে পুলিশের তৎপরতা চোখে পড়লেও ঈদ ঘনিয়ে আসতেই কমতে থাকে এ তৎপরতা। ফলে, আবারও পুরো ফুটপাত হকারদের দখলে চলে যায়। তবে, বঙ্গবন্ধু সড়কে কিছুটা তৎপরতা দেখা গেলেও কালিরবাজার, সিরাজদ্দৌলা সড়কসহ অন্যান্য সড়কগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ প্রশাসনের কোনো অভিযান বা কার্যক্রম চোখে পড়ে না।
তারা আরও অভিযোগ করে বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনের আগে এসব দখল মুক্ত করে হকারদের পুনর্বাসন করার অঙ্গীকার করলেও নির্বাচনের পর কোথাও তারা নিজেরা আবার কোথাও তাদের চ্যালা-চামচারা ফুটপাত দখল বাণিজ্যে নেমেছেন। ফলে, যানজটের কারণে শহর চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে যাচ্ছে। এজন্য প্রশাসনের ব্যর্থতা দায়ী। তারা সঠিকভাবে কাজ করে না। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার আইনগতভাবে সেটা নিশ্চিত করবে। কিন্তু, মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে তো ব্যবসার সুযোগ দিতে পারে না।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, সিটি করপোরেশনকে নগরীর ফুটপাত পরিচ্ছন্ন ও দখল মুক্ত রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ফুটপাত দখল মুক্ত রাখতে প্রয়োজন পুলিশের সদিচ্ছা।
অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ পুলিশের দাবি, পুলিশ অল্প সময়ের মধ্যেই নগরীর ফুটপাত দখল মুক্ত করতে পারে। তবে রাজনৈতিক বিভিন্ন বাধার কারণে এগুলো সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হলে নারায়ণগঞ্জের ফুটপাত দখল মুক্ত করতে ২ দিনের বেশি সময় লাগবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ১৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান বলেন, এটা এসপি সাহেব বুঝবে, এটা এসপি সাহেবের দায়িত্বে। হকার নেতা পলাশ আপনার নাম বিক্রি করে হকারদের বসায় এবং চাঁদাবাজি করে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, পলাশ আমার দলের লোক, তাই ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। কিন্তু আমি কোনো হকার বসাই নাই, এটা আমার পেশাও না, নেশাও না। আমি কোনো হকারের টাকা নেই না। তবে, সব সাংবাদিকরাই তো হকারের কাছ থেকে টাকা নেয়। এটার প্রমাণ আছে আমার কাছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, ফুটপাত একটি বড় সমস্যা এটা জানে সকলেই। এটা নিয়ে কথা বলতে কালকে অফিস টাইমে আমার কার্যালয়ে আসেন, কথা বলবো।
জেলা পুলিশ সুপার ও সিটি কর্পোরেশনের সিইও এবং নগর পরিকল্পনাবিদ’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কল রিসিভ করেননি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (‘ক’ সার্কেল) নাজমুল হাসান প্রথমে বলেন, আসলে ফুটপাতের বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব, আমি কিছুই বলতে পারবো না। পরক্ষণে তিনি বলেন, আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। ফুটপাত মুক্ত করতে হলে আসলে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন সহ বেশ কয়েকটি সংস্থাকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।




