আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পরও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন অলি-গলিতে বেড়েই চলছে মাদকের ভয়াবহতা ...

জেলাজুড়ে গোপনে মাদকের রমরমা বাণিজ্য

91
জেলাজুড়ে গোপনে মাদকের রমরমা বাণিজ্য

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

মাদকাসক্তি! যাকে বলা হয় সকল সন্ত্রাস ও অপরাধের জনক। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো মাদকের মহামারীতে আক্রান্ত বন্দর নগরী নারায়ণগঞ্জ। যদিও পুলিশ সুপার হিসাবে গোলাম মোস্তফা রাসেলের যোগদানের পর জেলাজুড়ে মাদকের ভয়াবহতা রোধ করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে শত শত মাদক সেবী, ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করেছেন, কিন্তু বর্তমানে এসব অপরাধীরা জামিনে বেরিয়ে আবারো মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। তবে এবার আর প্রকাশ্যে নয়, গোপনে চলছে মাদক সেবী ও ব্যবসায়ীদের বেচা-বিক্রি।

শহরের প্রধান প্রধান সড়কে আগে যেখানে মাদক সেবীদের আনাগোনা দেখা যেত, পুলিশের বিভিন্ন অভিযানের কারণে প্রকাশ্যে বা প্রধান প্রধান সড়কে না থাকলেও শহরের নানা অলি-গলিতে আবারো বাড়ছে মাদক সেবী ও মাদক কারবারীদের আনা গোনা। ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’ খ্যাত ঐতিহ্যবাহী শহর নারায়ণগঞ্জের এক সময় বেশ সুনাম থাকলেও বর্তমানে নানা সমস্যায় তা প্রায় হারাতে বসেছে। সবসময় নারায়ণগঞ্জ জেলার জন্য অন্যতম একটি বড় সমস্যা হলো মাদক। যার ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও। এসব মাদকদ্রব্য প্রকাশ্যে পাওয়া না গেলেও শহরের প্রায় সব অলি-গলিতেই সন্ধ্যা হওয়ার পরপরই পাওয়া যায়।

এ অবস্থায় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছে অভিভাবকরা। অভিভাবকদের মতে, একজন মানুষ যখন অন্ধকারের ভুবনে পা বাড়ায় তখন সে প্রথম সিঁড়ির যে ধাপটিতে পা রাখে তা মাদকদ্রব্য। এই মাদকদ্রব্য তাকে টেনে নেয়, উৎসাহিত করে পরবর্তী ধাপগুলো পেরিয়ে যেতে। আর তাই আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত যে সকল অপরাধ ঘটছে তার মধ্যে মাদক অন্যতম। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা ও বেশি আলোচিত বিষয়।

ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জে মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বর্তমান প্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকছেও বেশি- ঠিক যেমনটি প্রত্যাশা মাদক ব্যবসায়ীদের। ফলে আশংকাজনক হারে দিনদিন বেড়েই চলছে মাদকসেবীর সংখ্যা। তবে পুলিশি তৎপরতার কারণে এদেরকে কিছুটা দমন করা গেলেও জামিনে বের হয়ে এসে পুনরায় আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে মাদকের সাথে জড়িত এসব অপরাধীরা। নারায়ণগঞ্জ রাজধানীর খুব নিকটবর্তী হওয়ায় এখানে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মাদক ব্যবসা। জেলার প্রায় সব পাড়া-মহল্লাতেই মরণব্যাধী মাদকের ছড়াছড়ি।

নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় খুব সহজেই এখানে নদীপথে মাদক আসতে পারে কারণ মহাসড়কগুলোতে পুলিশ চেকপোষ্টের কারণে মাদক সরবরাহের চেয়ে নদীপথে নিরাপদ। মাদকসেবীরা বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের মধ্যে হিরোইন, কোকেন, আফিম, গাঞ্জা, ক্যানাবিস গাজা, হাশিশ, ফেনসিডিল, বিভিন্ন রকমের ইনজেকশন, ইয়াবা ট্যাবলেট, দেশী-বিদেশী মদ সেবন করে। শুধু এসবই নয় জুতায় লাগানোর আঠা বা ড্যান্ডি আঠা, চড়শ, কোডিন, মরফিন, বুপ্রেনর ফিন, প্যাথেডিন, মারিজুয়া এরোসোল্স, লাইটার ফ্লুইড, বার্ণিল রিমোভার, নেলপলিশ রিমোভার, পেইন্ট থিনার, স্পট রিমোভার, ক্লিনিং সল্যুশনস্, গুল সেবনে আসক্ত হয়ে পড়ে যুবসমাজ।

পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ঔষধ যেমন- এফ ফেটামিনস, বারবিচ্যুরেটস, সিডেটিড, হিপনোটিকস, ভ্যালিয়াম, ফ্রিশিয়াম, ইউনাকটিন, মেথাকোয়ালোন, জায়া জিপাম, নাইট্রাজিপাম ও ক্লোর ডায়াজিপোক্সাইড ইত্যাদি জাতীয় ঘুমের ঔষধ বাজারে পাওয়া যায়। যেগুলোর অধিক সেবনে মৃত্যু ঘটতে পারে। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার জেলাজুড়ে।

গোপন সূত্রের ভিত্তিতে জানা যায়, নারায়নগঞ্জে খুব সহজেই সর্বত্র ইয়াবা পাওয়া যায়। বর্তমানে বার্মা ও ইন্ডিয়া থেকে আসা ইয়াবার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এখানে। কার কথা বাদ দিয়ে কার কথা বলব। ১৩ বছর বয়সী ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধ শিক্ষক, মাঝবয়সী সরকারি কর্মচারী থেকে উঠতি বয়সের যুবক, ব্যবসায়ী থেকে চিকিৎসক সবাই আছেন। বড়ই মর্মস্পর্শী আর বিস্ময়কর তাঁদের জীবন কাহিনি। মাদকের নিষ্ঠুর পদাঘাতে কেউ লাখ লাখ টাকার ব্যবসা ধ্বংস করে সর্বস্বান্ত; কেউবা জড়িয়েছেন ভয়ংকর অপরাধ চক্রে। পরিবার তছনছ হয়ে গেছে কারও কারও।

তবে সবচেয়ে বেশী আসক্তি দেখা গিয়েছে উঠতি বয়সের তরুন-তরুনীদের মাঝে। বেশ কয়েক প্রকার ইয়াবা বিক্রি হয় নারায়নগঞ্জে এবং বিভিন্ন দামে বিক্রি হয় এই ইয়াবা। অভিনব কৌশলে বিভিন্ন পথে এই জেলায় আসছে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। এককথায় মাদকই এখন নারায়ণগঞ্জের অন্যতম প্রধান সমস্যা, যা পাওয়া যাচ্ছে হাত বাড়ালেই।

রেললাইনস্থ বস্তি, শহরতলীর দেওভোগ, ভোলাইল, পশ্চিম নগর, পূর্ব নগর, দেওভোগ মাদ্রাসা, মাদ্রাসা গাঙ্গুলি বাড়ি, বাশ মুলি, কাশিপুর, পানির টাংকি, দেওভোগ আখড়া, নন্দী পাড়া, গলাচিপা, বাবুরাইল, বাংলাবাজার, হাজীগঞ্জ, তল্লা, বরফকল, কলেজ রোড, সৈয়দপুর, আলামিন নগর, এবং শহরের অদূরের এলাকাগুলোতেও মাদকের কেনা-বেচা চলছে পুরোদমে অভিযোগ স্থানীয়দের। বিশেষত সন্ধ্যার পর মাদক বিক্রেতা ও ক্রেতাদের উৎপাত বেড়ে যায় দিনের তুলনায় বহুগুন। সব ধরনের মাদকের দেদার বেচাকেনা চলে সেখানে। মুঠোফোনে যোগাযেগে ঘরে বসেও পাওয়া যায় যে কোন ধরনের মাদকদ্রব্য। স্থানীয় যুবক ও কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা মাদকের ছোবলে হয়ে যাচ্ছে আসক্ত।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মাদকের ব্যবসা হচ্ছে তিনটি ধাপে। একটি দল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা মাদক নিয়ে আসে শহরে। তারা পৌঁছে দেয় শহরের এজেন্টদের কাছে। এজেন্টরা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে খুচরা বিক্রেতাদের দিয়ে এসব মাদক বিক্রি করায়। দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের মাদক বিক্রি, পরিবহন ও খুচরা বিক্রির কাজে ব্যবহার করছে নেপথ্যের হোতারা। তারা থেকে যাচ্ছে আইনের নাগালের বাইরে।

বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে সমাজে মাদকের প্রসার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে সূত্র জানায়। জেলার প্রতিটি পাড়া মহল্লায় মাদক বিক্রির আখড়া তৈরী করে মাদকের ব্যসা হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা যায় যায়, চাষাড়া রেললাইন বস্তিতে রয়েছে জেসমিন, আসলামসহ এদের পুরো পরিবারের নিয়ন্ত্রণ, পানির টাংকি-মাসদাইর-কলেজ রোড সহ আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে বন্দুক শাহীনের রেখে যাওয়া চেলাদের আধিপত্য, খানপুর-তল্লা-বরফকল সহ এ সমস্ত এলাকাগুলোর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে বাবু বাহিনী, একইভাবে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন বাহিনীর লোকজনেরা নিজেদের আধিপত্য ভাগা ভাগি করে অবস্থান নেয় এবং প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাদক বিক্রির পাশাপাশি সাধারন পথচারীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।

এলাকাগুলোর কোন শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে বলে অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তি বর্গ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সচেতন এলাকাবাসীরা বলছেন, নারায়নগঞ্জে মাদকের ব্যাপকতা সম্পর্কে প্রশাসন অবগত কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়মিত মাসোহারা প্রদাণে প্রশাসনের নীরবতা লক্ষণীয়। পুলিশ বেশ কয়েকবার এলাকাগুলোতে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীদের আটক করলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় অথবা টাকার বিনিময়ে তারা বের হয়ে এসে পুনরায় তাদের মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে এবং পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি পাবে। দেশের ভবিষ্যত প্রজম্ম নিয়ন্ত্রণহীন অবর”দ্ধ অবস্থার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রশাসনকে অগ্রগামী ভূমিকা পালনের আহবান জানান নারায়ণগঞ্জবাসী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিগারেট থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি আসক্তি ধীরে ধীরে শুরু হয়। বেশির ভাগই শুরু হয় বন্ধু-বান্ধবদের সাহচর্যে। মূলত মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর-তরুণরা ব্যাপকভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ সুযোগে মাদক ব্যবসায়ী, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। মাদকের এই নেশার জালে একবার জড়িয়ে পড়লে কেউ আর সহজে এ জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে মাদকসেবীরা দিনে দিনে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সর্বত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম।

তবে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জে এর বিরুদ্ধে বড় কোনো সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। মাদকবিরোধী উল্লেখযোগ্য সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা বা মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিও হচ্ছে না। সামাজিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, নারায়ণগঞ্জে যে হারে মাদকের ব্যবহার বাড়ছে তাতে করে নারায়ণগঞ্জের মানুষ বিশেষ করে যুবসমাজ চরম ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। তাদের মতে প্রশাসন সহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষদের উচিত নিজে সচেতন হওয়া। পাশাপাশি সন্তানদের প্রতি যত্নবান হওয়া, একই সাথে এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাদকের বিরুদ্ধে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত বলেও তারা মনে করেন।

সুশীল সমাজের এক প্রতিনিধি বলেন, একসময় নারায়ণগঞ্জে যে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন ছিল, এখন তা নেই। আন্দোলন হওয়া দরকার, সচেতন হওয়া উচিত এ ধরনের কথা সবাই বলছেন, কিন্তু দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে এগিয়ে এসে কেউ সক্রিয় হচ্ছেন না।

উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় কাশিপুরের মাদক ও সন্ত্রাসের দুই শীর্ষ অপরাধী সন্ত্রাসী সালাউদ্দিন সালু, সন্ত্রাসী রাজু, র‌্যাবের সাথে গোলাগুলিতে নিহত হয় চনপাড়ার মাদক ব্যবসায়ী সিটি শাওন, পাঁচ হাজার পিছ ইয়াবা নিয়ে স্বামীসহ গ্রেফতার হন আড়াইহাজারের উপ-কৃষি কর্মকর্তা আকলিমা আক্তার। শুধু আকলিমা আক্তারই নয়, এর আগে নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশের রুবেল নামে এক এএসআই ৫০ হাজার পিছ ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। সেই ঘটনায় সাবেক ওসি কামরুল ইসলামকে জেলও খাটতে হয়েছিলো। এরও আগে সাংবাদিক নামধারী মাদক ব্যবসায়ী হাতিম বাদশাকে একটি আবাসিক হোটেল থেকে মাদক সেবন করা অবস্থায় গ্রেফতার করেছিলেন তৎকালীণ নারায়ণগঞ্জ সদর ইউএনও গাউসুল আযম। এ ধরনের ঘটনা মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে। তবে ধরা পড়েনা পর্দার আড়ালের রাঘব বোয়ালরা।