জেলা-মহানগর আ.লীগসহ সকল অঙ্গসংগঠনে দেখা যাচ্ছে দুই গ্রুপের বিরোধ...

আবারও শামীম-আইভীতে বিভক্ত না.গঞ্জ আ.লীগ

50
আবারও শামীম-আইভীতে বিভক্ত না.গঞ্জ আ.লীগ

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

আবারও উত্তর-দক্ষিণ বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। দুই বলয়ের ২ শীর্ষ নেতা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যকার দ্বন্দ্বে জেলা-মহানগর আওয়ামীলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ দ্বন্দ্বের কারণে জেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন ও মহানগর আওয়ামীলীগসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের সম্মেলন ও নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া আটকে আছে দীর্ঘ সময় ধরে।

ফলে স্থানীয় রাজনীতিতে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামীলীগ, ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে দলটি। এতে করে বিপাকে পড়েছে দেশের সবচেয়ে পুরাতন এ রাজণৈতিক সংগঠনটির তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। তাদের দাবি, বড় বড় নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে আমরা সাধারণ নেতাকর্মীরা দিশেহারা। এক নেতার সাথে গেলে আরেক নেতার বিরাগভাজন হতে হয়। তাই, এখন দলীয় কর্মসূচীতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।

এদিকে, দিন দিন শামীম-আইভীর দ্বন্দ্ব বাড়ছেই। কোনোভাবে কমানো যাচ্ছেনা উভয়ে বলয়ের মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব। কিছুদিন আগেও দুজনের মাঝে কথার লড়াই দেখা যেতো, একজন অপরজনকে ঘায়েল করে হরহামেশাই বক্তব্য রাখতেন। এমনকি, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের সামনেও একে অপরকে ঘায়েল করে বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে এ দুজনকে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে এ দুইজনের কথার লড়াই বন্ধ হলেও সমন্বয়হীণতার কারণে দীর্ঘ ৮ মাসেও সম্ভব হয়নি জেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন। উল্টো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পৃথক পৃথকভাবে তালিকা দিয়েছেন কেন্দ্রের কাছে, যেখানে নিজ্ব নিজ্ব বলয়ের নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এমনকি দুজনেই নিজ্ব নিজ্ব পরিবারের সদস্যদেরও রেখেছেন পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকায়। যা নিয়ে কিছুদিন যাবৎ ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়ে উভয়কে।

জেলার পাশাপাশি মহানগর আওয়ামীলীগেও ভাঙ্গন এখন স্পষ্ট। শামীম-আইভীতে বিভক্ত হয়ে গত ২ বছর ধরে আলাদা আলাদা কর্মসূচী পালন করতে দেখা গেছে সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক এড. খোকন সাহাকে। যদিও মাঝেমাঝে তাদের একসাথেও দেখা যেতো, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ হারানোর পরে আকারে-ইঙ্গিতে শামীম ওসমান ও এড. খোকন সাহার বিরুদ্ধাচারণ করে বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতিকে। একইভাবে আনোয়ার হোসেনের নানা কর্মকান্ডের বিরোধীতা করে তীব্র সমালোচনা করতে দেখা গেছে সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহাকেও।

অবস্থা এখন এমন দাড়িয়েছে যে, জেলা-মহানগর আওয়ামীলীগের ব্যানারে ৪ ভাগে ভাগ করে দলীয় ও জাতীয় কর্মসূচীগুলো পালন করা হয় নারায়ণগঞ্জে। সর্বশেষ গতকাল আওয়ামীলীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসেও আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা সভা ও র‌্যালি করে জেলা-মহানগর আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দরা। এদিন সকালে জেলা আওয়ামীলীগের ব্যানারে ২নং রেল গেইটস্থ আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে জেলার সভাপতি আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, সাধারণ সম্পাদক এড. আবু হাসনাত শহিদ মো. বাদলের নেতৃত্বে একইস্থানে আলোচনা ও র‌্যালি করা হয়। মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এড. খোকন সাহার নেতৃত্বে পুরাতন কোর্ট এলাকায় তার নিজ কার্যালয়ে কর্মসূচী পালন করা হলেও সন্ধ্যায় সভাপতি আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে দিবসটি পালন করা হয়।

বড়দের পথ ধরে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, কৃষকলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগসহ সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা নিজেদের মাঝে এ দ্বন্দ্ব বিবাদমান রেখেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে থাকলেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণে সংগঠনগুলোর নতুন কমিটি গঠন করতে বা সম্মেলন আয়োজন করতে পারছেনা সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরাও দাবী সুত্রের। ফলে পদ-প্রত্যাশী নেতাকর্মীরা দিনদিন রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে আগামী নির্বাচনের আগ মুহুর্তে নারায়ণগঞ্জে কিছুটা বেকায়দায় পড়তে পারে আওয়ামীলীগের এমপি প্রার্থীরা।

সুত্র মতে, এমপি শামীম ওসমান ও মেয়র আইভী সবসময়ই চান কমিটিগুলোতে নিজ¦ নিজ¦ বলয়ের নেতাদের অধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখতে। সংগঠন করুক চাই না করুক, যোগ্য হোক কিংবা না হোক, নিজের আস্থাভাজনদের সবসময় নেতৃত্বে দেখতে চান দুজনেই। এ লক্ষ্যে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করেন তারা।

তবে তৃণমূলের দাবি, দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছে, উভয়ের মতপার্থক্যের কারণে সংগঠনগুলোর নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া আটকে আছে। ফলে বিরোধী দলের তুলনায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলে অনেকটা এগিয়ে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগ।

জানা গেছে, গত অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় জেলা সম্মেলন ঘিরে প্রথম দিকে নানা শঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে। কেননা শামীম ওসমান অনুসারী নেতাকর্মীদের দাবি ছিলো তাকে যেন সভাপতি করা হয়। বিপরীতে আইভী অনুসারীরা এই পদে শামীম ওসমানকে চাচ্ছিলেননা তাও ছিলো স্পস্ট। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলন। সেখানে সভাপতি করা হয় আবদুল হাইকে এবং সম্পাদক করা হয় ভিপি বাদলকে। সভাপতি-সম্পাদকের নাম ঘোষণার পরই শামীম-আইভীতে আলাদা হয়ে পৃথক পৃথকভাবে বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করতে দেখা গেছে তাদের।

এদিকে, এই সম্মেলনের ২দিন পর অর্থ্যাৎ ২৫ অক্টোবর মহানগর আওয়ামীলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। তবে, সভাপতি-সম্পাদকের মতবিরোধের কারণে গত ৭ বছরেও কোনো ইউনিট কমিটি গঠন করতে না পারায় সেই সম্মেলন স্থগিত রাখা হয়। এতে নতুন করে আলোচনায় আসে আইভী অনুসারী আনোয়ার হোসেন ও শামীম অনুসারী খোকন সাহার মধ্যকার বিরোধের বিষয়টি। ফলে ৩ বছরের কমিটি ৭ বছর অতিবাহিত করলেও নতুন কমিটি করা সম্ভব হচ্ছে না।

মহানগর আওয়ামীলীগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের ৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্নাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০১৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি ঘোষণা করা হয়েছিল আনোয়ার হোসেনকে ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় অ্যাডভোকেট খোকন সাহাকে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর প্রথমদিকে একসাথে রাজনীতি করলেও ধীরে ধীরে দুই বলয়ের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

যুবলীগ সুত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৭ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৫ সালে গঠিত হয় তৎকালীণ শহর যুবলীগের কমিটি। যেখানে সভাপতি করা হয় শাহাদাৎ হোসেন ভুইয়া সাজনুকে এবং সম্পাদক হন আহাম্মদ আলী রেজা উজ্জ্বল। এক বছর পর ২০০৬ সালে গঠন করা হয় জেলা যুবলীগের কমিটি। যেখানে আব্দুল কাদিরকে সভাপতি ও ভিপি বাদলকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। শামীম-আইভী বিরোধের কারণে মহানগর আওয়ামীলীগের মতো তারাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

জেলা যুবলীগের সভাপতি ইতিমধ্যেই জেলা আওয়ামীলীগের বিগত কমিটির সহ-সভাপতি এবং ভিপি বাদল ২য় বারের মতো জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। বিপরীতে শহর যুবলীগের দুই নেতা ৪০ বছর পার করেছেন, তবুও তারা যুবলীগের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৬ বছরের পুরোনো দুই কমিটি এখনো বহাল থাকায়, দীর্ঘ সময়ে কোনো নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। পদ-প্রত্যাশী নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে রাজনীতি বিমুখ হচ্ছেন। এতে করে সার্বিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটি।

ছাত্রলীগ সুত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই জেলা-মহানগর ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তবে, গত বছরের জানুয়ারীতে মহানগর আওয়ামীলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও দীর্ঘ ১৭ মাসেও নতুন কমিটি গঠন করা হয়নি। এই কমিটিও শামীম-আইভী দ্বন্দ্বের কারণে আটকে আছে বলে মনে করেন ছাত্রলীগের পদ-প্রত্যাশী নেতাকর্মীদের অনেকে।
স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও কৃষকলীগেও একই দশা চলমান।

স্বেচ্ছাসেবকলীগ সুত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২০ জুলাই কেন্দ্র থেকে মহানগর কমিটির সভাপতি হিসাবে মোঃ জুয়েল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ২৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর দুলাল প্রধানসহ ৭৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। তারা দুজনই শামীম ওসমানের অনুসারী হিসাবে চিহ্নিত। ছাত্রলীগের পাশাপাাশি জুয়েল-দুলালের নেতৃত্বাধীণ মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের কমিটিও বিলুপ্ত করা হয় গত সিটি নির্বাচনের আগে। স্বেচ্ছাসেবকলীগের কমিটি নিয়েও উভয় বলয়ের নেতাকর্মীদের মাঝে দ্বন্দ্ব বিরাজমান। উভয় পক্ষই চাই নিজের বলয়ে রাখতে স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনটিকে।