"ঘুষ দূর্নীতি আর ন্যায় বিচার এক সাথে চলেনা" -----...

আদালতে ১৮ জায়গায় দিতে হয় ঘুষ

186
আদালতে ১৮ জায়গায় দিতে হয় ঘুষ

অতিথি কলাম, আহমদ তমিজঃ 

গ্রিক দার্শনিক পন্ডিত সক্রেটিসকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মানুষের জীবনের জন্য কোন জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?  তিনি জবাব দিয়েছিলেন সুবিচার।  এর কারন হচ্ছে – সমস্ত ভাল শুধু সুবিচার থেকে উৎসারিত। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) বলেছিলেন – একটি রাষ্ট্রের পতন হয় দেশ থেকে সুবিচার  উঠে গেলে। কারণ, সুবিচারে রাষ্ট্র স্থায়ী  হয়। বলা  হয়ে থাকে আইন-আদালত হচ্ছে  গরিব অসহায় ও মজলুম মানুষের  শেষ ভরসাস্থল। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায় বতমানে আইন আদালত এখন গরিব-অসহায় মানুষের হয়রানি ও চরম ভোগান্তির স্থলে  পরিনত হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন  গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও প্রতিবেদনে  এর সত্যতা লক্ষ্য  করা যাচ্ছে |

প্রশ্ন উঠেছে জেলার আইনজীবী সমিতির ভূমিকা কি? তারা  একটি জবাবদিহিমূলক বার ও বেঞ্চ সৃষ্টিতে কতটা ভুমিকা রাখেন? পত্রিকার প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে – দেশের প্রতিটি জেলা আদালতে এক শ্রেনীর সেরেস্তাদার, পেশকার ও তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদেরকে অলিখিত ভাবে ঘুষ প্রদান করতে হয়, দিতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় কোন আইনজীবী যদি এ ব্যাপারে মুখ খোলেন বিদ্রোহী হন তবে তার বিরুদ্ধে জজ সাহেব তার অধিনেস্থ কর্মচারিদের নালিশের কারনে উল্টো আইনজীবিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গহন করে আইনজীবী সমিতিতে নালিশ করতে ও দ্বিধা করেন না|

জানা গেছে, ১০ অক্টোবর ২২ সালে মানিকগঞ্জ জেলা আদালতে প্রাঙ্গণে আইনজীবী সমিতির সদস্য এডভোকেট মাহবুবুল ইসলামের নেতৃত্বে তার কয়েকজন সহযোগী  আইনজীবী  বিচার বিভাগের বিভিন্ন অনিয়ম, ঘুষ ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে মানববন্ধন  কর্মসূচি  পালন করেন| তারা দাবি করেন মামলার এফিডেভিট করতে নিদিষ্ট ফ্রি ছাড়াও অতিরিক্ত তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা ঘুষ দিতে হয়। নকলখানা থেকে এক হাজার টাকার কমে কোন নকল পাওয়া য়ায় না।

রেকর্ডরুম থেকে মামলার নথি পেতে হলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। জেলার বিচার বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকতা-কর্মচারীদের জন্য বিচারপ্রার্থী অসহায় মানুষের মামলার খরচ অনেক বেড়ে যায়।

আরও জানা গেছে “ঘুষ দূর্নীতি আর ন্যায় বিচার এক সাথে চলেনা” স্লোগান  সম্মিলিত  লিফলেট বিতরণ ও মানববন্ধন কমসৃচী পালন করায় গত ১৬ অক্টোবর ২২ সালে এড. মাহবুবুল ইসলাম ও তার সহযোগী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আইনজীবী সমিতিতে একটি নালিশ দেন মানিকগঞ্জ জেলা ও সিনিয়র দায়রা জজ আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে এড. মাহবুবুল ইসলামকে কারন দর্শানোর নোটিশ দেন মানিকগঞ্জ বার সমিতির সভাপতি জামিলুর রশিদ খান ও সাধারণ সম্পাদক নুরতাজ আলম বাহার।

নোটিশে বলা হয়, তার ও তার সহযোগী আইনজীবীদের কর্মকান্ডে বার ও বেঞ্চের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে| জেলা আইনজীবী সমিতির গণতন্ত্রের দ্বাদশ অধ্যায়ের ২০ এর ক অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করায় আইনজীবী মাহবুবুল ইসলামকে ১৫ কর্ম  দিবসের জন্য আইন পেশা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এব্যাপারে আইনজীবী সমিতির সভাপতি গণমাধ্যমকে বলেন, আদালতে ঘুষ-দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে সমিতির গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেছে আইনজীবী মহবুবুল ইসলাম।

এদিকে, নোটিশ প্রাপ্তির পরপরই মাহবুবুল ইসলাম এর প্রতিবাদে মানিকগঞ্জ জেলা জজ আদালত চত্বরের সামনে গলায় প্লেকার্ড ঝুলিয়ে এর প্রতিবাদ করেন। প্লেকার্ডে লিখেন, ঘুষের চেয়ে ভিক্ষা উত্তম, করলাম  প্রতিবাদ হইলাম বহিষ্কার। আদালতে ঘুষ-দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে আমাকে ভিক্ষা দিন।

তিনি বলেন, আদালতে অসাধু কর্মচারি ও কর্মকর্তাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে একজন বিজ্ঞ জজ সাহেবের নালিশের কারণে আমাকে হয়রানি ও আইন পেশা থেকে বে-আইনিভাবে বিরত রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যেখানে প্রতিদিন আদালতে ঘুষের কারবার চলে এর বিরুদ্ধে কথা বললে প্রতিবাদ করলে নাকি বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সু সম্পর্ক নষ্ট হয়। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আমরা আর কত ঘুষ দূর্নীতি অপরাধ সহ্য করবো?  এ ব্যাপারে গত ২৪ অক্টোবর ২২ সালে সুপ্রিম কোর্টে ব্যারিষ্টার মো আশরাফুল ইসলাম আশরাফ মানিকগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির এই সিদ্ধান্তর বিরুদ্ধে হাইকোর্ট একটি রিট দায়ের করেন। রিটে উল্লেখ করা হয়, আদালতে ঘুষ দূর্নীতির প্রতিবাদে সহযোগী  আইনজীবীদের নিয়ে  মানববন্ধন করায় আইনজীবী মাহবুবুল ইসলামকে ১৫ দিনের জন্য আইন পেশা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক?

রিটে আইন সচিব, সুপ্রিম কোটের রেজিস্ট্রার জেনারেল, দুদকের চেয়ারম্যান ও বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়। রিটের আবেদনে মানিকগঞ্জ জেলা আদালতে ঘুষ দূর্নীতির বিষয়ে তদন্তে নির্দেশনা চাওয়া হয় এবং মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতিকে জেলা জজের পাঠানো চিঠির বৈধতাও চ্যালেঞ্জ করা হয়।

আশার কথা হলো, মাননীয় হাইকোর্ট রিট আবেদনে সাড়া দিয়ে মানিকগঞ্জ বার সমিতি কর্তৃক আইনজীবী মাহাবুবুল ইসলামকে বহিষ্কার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। একই সঙ্গে আইনজীবীর বিষয়ে বার সমিতিতে নালিশ করা জেলা জজের প্রদত্ত চিঠি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে জানতে চেয়ে রুল জারী করেন। এর পাশাপাশি  মানিকগঞ্জ আদালতে ঘুষ দূর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেয়া হয়।

এর আগে, ২০১১ সালের মার্চ মাসে দৈনিক যুগান্তরে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। সেখানে লেখা হয়েছিল – সুপ্রিম কোর্ট থেকে গায়েব হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ নথি, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নথি গায়েব হয়ে যায়, হারিয়ে যায় বা উধাও হয়ে যায়।আসলে নথি সেরেস্তা থেকে এক শ্রেণীর কর্মচারী নথি লুকিয়ে রাখে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আবার পয়সা দিলে ঠিকই নথি বের করে দেওয়া হয়। এ ঘটনা দেশের অধঃস্থন আদালত গুলোতে অহরহই ঘটে চলছে।

নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের একজন আইনজীবী জানান, আমার একটি দেওয়ানী মামলা কোর্ট বদলি করলে ধার্য তারিখে কোর্টে যোগাযোগ করলে পেশকার বলেন, পূর্বের সংশ্লিষ্ট কোর্ট থেকে নথি এখনো আসেনি এ ব্যাপারে পূর্বের কোর্টের সেরেস্তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনাটি একজন অভিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি হেসে বললেন, সেখানে খরচ দিন, মালপাতি খরচ করেন পেয়ে যাবেন। পরে ২’শ টাকা ঘুষ দিলে ঠিকই সংশ্লিষ্ট কোর্টে নথি পাঠিয়ে দেয়।

সম্প্রতি, একটি দেওয়ানী খারিজ মামলার নকলের জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসে দরখাস্ত দিলে, নকলের জন্য এক হাজার টাকা ছাড়া নকল সরবরাহ করা হয়নি, শুধু তাই নয় জেলা ও দায়রা জজ বাহাদুরের আদালতের সেরেস্তায় আপিল মামলাটি দায়ের করতে গেলে, বলা হয় খরচ দিন, পাঁচশ টাকার কমে হবেনা। কেননা অফিসের অনেককেই ভাগ দিতে হয়।

সব দেশেই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য আইন রয়েছে, আমাদের দেশেও রয়েছে। কিন্তু আদালতের এক শ্রেণীর কর্মচারীর ঘুষ বাণিজ্য মামলার মক্কেল ও আইনজীবীদের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়ছে। যেখানে অসহায় মানুষ জাস্টিস তথা ন্যায় বিচার ও ইনসাফ পাওয়ার কথা। সেখানে ঘুষ বাণিজ্যের কারণে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।

এহেন অলিখিত ঘুষ বানিজ্য থেকে মুক্তি কিভাবে সম্ভব? এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ মহলের বক্তব্য হচ্ছে, একমাত্র একটি জবাবদিহি মূলক বার সৃষ্টি ছাড়া এ অবৈধ ও কুপ্রথা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। এক কথায়, আইনজীবীদের ঐক্যের প্রতিষ্ঠান জেলা বার সমিতিকেই এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ব্যাক্তিগত প্রতিবাদ মানববন্ধন করে এর মূল উৎপাটন সম্ভব নয়।

পাদটীকাঃ একদা নারায়ণগঞ্জ শহরের অভিজাত ও এলিট শ্রেণীর ক্লাব হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিঃ প্রাঙ্গণে নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির বার্ষিক অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু। তিনি তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন, আদালতে যারা মামলা করতে আসেন তাদেরকে ১৮ জায়গায় ঘুষ দিতে হয়। তিনি তার ব্যাখ্যায়  বলেন, আমি এক সময় কুমিল্লা জজকোর্টের উকিল ছিলাম, তখন আমার পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবতার কারনে আমি এটা জানতে পেরেছি। তবে নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টে কত জায়গায় ঘুষ দিতে হয় তা হয়তো বলতে পারবেন- বর্তমান পিপি সাহেব।

পূনশ্চঃ সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম লিগ্যাল এইডের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন আইন ধনীদের জন্য, এ ব্যাপারে ধনীরাই বেশি এগিয়ে।  এর কারন হচ্ছে, ধনীদের অর্থ আছে। তারা ভালো আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন। ভাল আইনজীবীর পিছনে খরচ করতে পারেন, এ কারণে আইন ধনীদের পিছনে ধাবিত হয়। আর এটাই বাস্তব।

লেখকঃ আইনজীবী ও সাংবাদিক