আজ বিশ্ব মা দিবস : কয়েকজন রত্নগর্ভা মহিয়সী মায়েদের কথা

58
আজ বিশ্ব মা দিবস : কয়েকজন রত্নগর্ভা মহিয়সী মায়েদের কথা

আহমদ তমিজ :

আজ বিশ্ব মা দিবস’ এ দিবসকে কেন্দ্র করে-দেশ-বিদেশে মায়েদেরকে নিয়ে-বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছেন। আজকের এই দিনে এমন কয়েকজন রত্নগর্ভা মহীয়সী মায়েদের নিয়ে এই আলোচনা, যাদের সন্তানরা মানুষের জন্য বিশ্ব মানবতার জন্য অবিস্মরণীয় কাজ করে-নিজেরা যেমন স্মরণীয়-বরনীয় হয়েছেন অন্য দিকে তাদের সকল সফলতার মূলে ছিল তাদের মায়েদের ঐতিহাসিক ভূমিকা।

(এক) বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের কথা আমরা সবাই জানি। যিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে বৈদ্যুতিক বাত্তি, চলচ্চিত্র অডিও রেকর্ডিং এ্যানক্রিপ্টেড, টেলিগ্রাফ – সিস্টেম ও আধুনিক ব্যাটারী সহ হাজারো আবিষ্কার করে -পৃথিবীর মানুষদেরকে ঋণি করে গেছেন। কিন্তু এই মহান বিজ্ঞানী মাত্র ১২ সাপ্তাহ স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, ১২ সাপ্তাহ স্কুলে পড়া এডিসনের বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়ার পিছনে ছিল তার প্রেরনাদায়ী মায়ের আস্থা ও বিশ্বাস সাথে ছিল এডিসনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যাবসা।

ছোট বেলায় টমাস এডিসন “স্কারলেট-ফিবার” নামক এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। যার ফলে তিনি কানে কম শুনতে পেতেন, ১২ সাপ্তাহ স্কুলে পড়া এডিসনের স্কুলের পারফরম্যান্স এতোটাই খারাপ ছিল যে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে টমাসের মাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটি চিঠি দিয়েছিল সেখানে লিখেছিল “টমাস লেখাপড়ায় একেবারেই অমনোযোগী, একদম মেধা শূন্য, তাকে আমাদের স্কুলে রাখা সম্ভব নয়” কিন্তু টমাস এডিসনের মা চিঠিটা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে এই ভাবে পরেছিলেন – টর্মাসের মেধা শক্তি অসাধারণ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে সে অনেক ভাল অগ্রসর। তাই এতবড় মেধাবী ছাত্রকে পড়াশোনার সক্ষমতা আমাদের মতো সাধারণ স্কুলের নেই। কাজেই তাকে যেন বাড়িতে রেখে পড়ানো হয়। এভাবে উল্টো করে স্কুলের চিঠিটা পড়ার কথা গুলো টমাসের অন্তরকে লেখা পড়ার প্রতি আস্থাশীল ও অনুপ্রাণিত করেছিল। পরবর্তীতে টমাস এডিসন কঠিন কঠিন বিষয়ে অধ্যায়নও গবেষণায় দিন- রাত নিজেকে নিমগ্ন রেখেছিলেন। এভাবেই মায়ের আস্থা ও বিশ্বাসের কারনে তিনি একজন বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি নাম করেছিলেন।

(দুই) উপমহাদেশের বিখ্যাত সোহরাওয়ার্দী” পরিবারের সদস্য ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গনতন্ত্রের প্রতি তার অবিচল আস্থা ও গভীর বিশ্বাসের কারনে দেশবাসী তাকে গনতন্ত্রের “মানস পুত্র” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। সেই সোহরাওয়ার্দী শৈশবে খুবই ডানপিটে ও লেখাপড়ার প্রতি যথেষ্ট অমনোযোগী ছিলেন। একদিন তার গৃহ শিক্ষক সকলে পড়াতে এসে তার অমনোযোগীতার কারণে তাকে বেত্রাঘাত করলে সোহরাওয়ার্দী শিক্ষকের হাত থেকে সেই বেত কেড়ে নিয়ে তাকে বেত্রাঘাত করতে থাকলে শিক্ষকের চিৎকার শুনে তার মা ছুটে এসে বেত কেরে নিয়ে গিয়ে তাকে শান্ত করলেন। বেত্রাঘাতে আহত ও ক্ষুব্ধ শিক্ষক সোহরাওয়ার্দীর মাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনার এই বে-আদব ছেলের লেখাপড়া কিছুই হবেনা সে মূর্খ হবে। তার কথা শুনে সোহরাওয়ার্দীর মা শান্ত ও আস্থার সাথে বললেন, ওর তেমন কোন লেখা পড়া না হলেও চলবে। একজন সামান্য ব্যারিষ্টার হলেও চলবে। পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী তার মায়ের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে শুধু একজন প্রখ্যাত ব্যারিষ্টার’ ই নয় উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হয়ে অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন।

(তিন) হাজী মোহাম্মদ মহসীন। যিনি দয়ালু মহসীন নাম গরীব-দুঃখী মানুষের নয়নের মনি হিসেবে পরিচিতি লাভ করিছিলেন। তিনি তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ মহসীন ট্রাষ্ট-এর নামে উইল করে দিয়ে উপমহাদেশের হতদরিদ্র গরীব অসহায় মানুষ জনের জন্য লেখা পড়া করার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। অনেক বিখ্যাত মানুষও তার ট্রাষ্টের টাকায় উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। এখন ও পেয়ে আসছে। সেই মহসীনের বয়স যখন ৯/১০ বছর, তখনকার একদিনের ঘটনা। কি কারনে বাড়ির এক বৃদ্ধ চাকর তার হুকুম তামিল করতে দেরী করায় মহসীন তাকে একটি চপেটাঘাত করে বসেন। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পরপরই তিনি সংকিত হয়ে পরেন। তার ভয় এজন্য তার কঠিন ও কোমলের স্নেহময়ী মা তাকে কঠিন শাস্তি দিতে দ্বিধা করবেননা। ভয়ে তিনি তৎক্ষনাৎ বাড়ি থেকে পালিয়ে অনেক দূরে তার এক খালার বাড়িতে চলে যান। এভাবে সপ্তাহকাল কেটে যাওয়ার পর তার খালা মহসীনের মাকে খবর পাঠালেন তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু মহসীনের মা বলে পাঠালেন, এমন বে-আদব ছেলের জায়গা আমার বাড়িতে নেই। খালা মহসীনের কাছ থেকে সব ঘটনা শুনে তাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে চলে এলেন। খবর পেয়ে মহসীনের মা দরজার সামনে দাড়িয়ে বললেন এ বে-আদব ছেলের এ বাড়িতে ঢুকার অনুমতি নেই। তাহলে এখন তাকে কি করতে হবে! মা অত্যান্ত দৃঢ়কণ্ঠে বললেন সে বৃদ্ধ চাকরের কাছে তার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বলতে হবে-জীবনে এমন কাজ আর কখনোই করবেনা।

ইতিমধ্যে সেই বৃদ্ধ চাকরকে ডেকে আনা হলো। মহসীনকে দেখে বৃদ্ধ চাকরের দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। মহসীনকে মা হুকুম করলেন যাও তার পা ধরে ক্ষমা চাও মহসীন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে এগিয়ে গিয়ে যেই তা পা ধরতে যাবে বৃদ্ধ চাকর তাকে বুকে জরিয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মহসীন তার মায়ের এই শিক্ষা সারাজীবন মনে রেখে ছিলেন। মহসীন যত দিন বেঁচে ছিলেন, অসহায় সাধারণ মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ও উম্মুক্ত ভালবাসার সাক্ষর রেখে গেছেন।

(চার) দিনটি ছিল পবিত্র ঈদ-উল আযহার। মহানবী (সাঃ) কুরবানী শেষে মিসকিনদের মাঝে গোসত বিতরণ করছেন। এসময় একজন সাহাবী হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এসে জানালেন, একজন বেদুইন রমনী এসে হাক-ডাক করছে, বলছে মোহাম্মদ কোথায় ? আমার ছেলে মোহাম্মদ কোথায়? তাকে ডাকো বল তোমার মা এসেছেন।

মহানবী (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কি নাম তার? জবাব এলো হালিমা। রাসূল (সাঃ) কালবিলম্ব না করে তার মাথার পাগড়িটি খুলে তার হাতে দিয়ে বললেন। যাও এটি তার পায়ের তলায় বিছিয়ে দাও পাখা দিয়ে তাকে বাতাস দাও, আর কিছু মিষ্টি খাবারের ব্যবস্থা কর। আর বলবে আপনার ছেলে কুরবানির গোশত বিতরণ করে এখনই আসছে।

রাসূলের স্মৃতি পটে ভেসে উঠলো তৎকালীন আরবের প্রথানুযায়ী জম্মের পর শিশু মুহাম্মদকে হালিমার কাছে দেওয়া হলো – তাকে লালন পালনের জন্য। ৬ বছর হালিমার পরিবারের লালিত পালিত হয়েছেন তিনি। এতো তার “দুধমা হালিমা” কিছুক্ষণ পর রাসূল (সাঃ) এসে তার পায়ের কাছে বসে বললেন, মা আপনি কেমন আছেন? আমার ভাই বোনেরা (হালিমার ছেলে মেয়েরা) কেমন আছে? হালিমা বললেন, বয়স হয়েছে। এ কারনে তেমন চলাফেরা করতে পারিনা বাবা। তোমার ভাই বোনেরা ভালো আছে। অনেক দিন থেকে তোমাকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। আজ এদিকে একটি জরুরী কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম এ সুযোগে একবার তোমাকে দেখে যাই বলেই রাসূলের চেহারা মোবারকে বারবার হাত বুলাতে লাগলেন।

এ সময় একজন সাহাবী কিছু মিষ্টি খাবার নিয়ে এলে রাসূল (সাঃ) নিজ হাতে হালিমার মুখে তুলে দিলেন। হালিমাও রাসূল (সাঃ) মুখে মিষ্টি তুলে দিলেন। এসময় চারপাশে দাড়ানো সাহাবীরা অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আবেগ আপ্লূত হলেন। হালিমাকে এখানে কিছুদিন থেকে যাওয়ার জন্য বললেন- হালিমা বললেন, বাবা আমাকে এখনই বেলা থাকতে থাকতে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। মহানবী (সাঃ) হালিমা ও তার ছেলে মেয়েদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী দিয়ে তাকে বাহনে চড়িয়ে তার দড়ি ধরে হেটে হেটে প্রধান রাস্তায় এগিয়ে দিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত হালিমা ও তার বাহনকে দেখা গেল ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানালেন।

(পাচঁ) বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জম্মের আগে তার পিতা আবদুল্লাহ সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী আমেনার খেদমতের জন্য বাজার থেকে ৯/১০ বছরের এক কৃতদাসীকে কিনে নিয়ে এলেন। তার নাম জিজ্ঞেস করলে জানায় উম্মে আইমান, তার ব্যবহার ও কাজে মুগ্ধ হয়ে আবদুল্লাহ ও আমেনা তার নাম রাখলেন বারাকাহ বা ভাগ্যবতী।

রাসূল (সাঃ) দুনিয়ায় আগমনের সময় সর্ব প্রথম কৃতদাসী বারাকাহ তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। পরে আমেনার মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে এলো তিনি বারাকাহকে ডেকে বলেছিলেন আমি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে তুমি মুহাম্মদকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। তাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখবে। বারাকাহ তার কথা রেখেছিলেন, মুহাম্মদ (সাঃ) ও বারাকাহকে মায়ের মতো সবসময় সম্মান ও ভালবাসা দেখিয়েছেন।

রাসূল (সাঃ) যখন কৈশোরে উত্তীর্ণ হলেন, একদিন তিনি বারাকাহকে বললেন, আপনি মুক্ত – স্বাধীন ইচ্ছে করলে যেখানে খুশি চলে যেতে পারেন। বারাকাহ বললেন, মুহাম্মদ (সাঃ) আমি তোমার মা আমেনার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। রাসূল (সাঃ) খুশি হলেন। এক সময় রাসূল (সাঃ) তাকে এক সাহাবীর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন বিয়ের মজলিসে উক্ত সাহাবীকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি জানো তুমি কাকে বিয়ে করছো? সাহাবী তার দিকে তাকালে রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি আমার মাকে বিয়ে করছো।

রাসূল (সাঃ) যখন মদিনায় হিজরত করলেন এর পর পরই বারাকাহ ও মদিনায় হিজরত করে রাসূলের কাছে চলে গেলেন। আমৃত্যু তিনি রাসূলের সাথেই ছিলেন।

লেখক: আইনজীবী / সাংবাদিক