অব্যাবস্থাপনা সর্বত্র, নারায়ণগঞ্জ এখন বসবাসের অযোগ্য শহর

79

স্টাফ রিপোর্টার :

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে অলিগলি কোথাও স্বস্তি নেই। প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত এই শহর এখন কার্যত ‘অচল নগরী’তে পরিণত হয়েছে। শহরের তিনটি প্রধান অংশে একসাথে চলমান উন্নয়ন কাজ, সমন্বয়হীনতা এবং ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রশাসনিক ঢিলেমিতে নাগরিক জীবন এখন চরম বিপর্যস্ত।
বিশেষ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড, পঞ্চবটি-মুক্তারপুর ৬ লেন প্রকল্প এবং শহরের প্রাণকেন্দ্র বিবি রোডের অপরিকল্পিত ড্রেনেজ কাজÑএই তিনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির মানুষ।
লিংক রোড: সাইনবোর্ড থেকে স্বস্তি, চাষাড়ায় এসেই নরকযন্ত্রণা
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ৬ লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল অনেক আগেই। সাইনবোর্ড থেকে চাঁদমারী পর্যন্ত রাস্তাটি চলাচলের উপযোগী হলেও, চাঁদমারী থেকে চাষাড়া পর্যন্ত মাত্র ১ কিলোমিটার অংশ এখন নগরবাসীর গলার কাঁটা।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্রে জানা যায়, ৪টি মেয়াদ বাড়িয়েও এই অংশের কাজ শেষ হয়নি। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ঠিকাদারি জটিলতায় কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। বর্তমানে রাস্তায় বড় বড় গর্ত, নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ এবং লেনের সংকীর্ণতায় এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকছে।
মসজিদ সরানোর পরেও কাজ না হওয়ায় ক্ষোভ:
সড়কটি প্রশস্ত করার স্বার্থে স্থানীয়রা বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন। উন্নয়নের স্বার্থে প্রায় ৬ মাস আগে এই অংশের একটি মসজিদ বিকল্প স্থানে স্থানান্তর করে ভেঙে ফেলা হয় এবং জায়গা খালি করে দেওয়া হয়। কিন্তু ধর্মীয় স্থাপনা সরানোর পরেও দীর্ঘ দিনেও কেন রাস্তার কাজ শেষ হচ্ছে না বা দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেইÑতা নিয়ে জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ সওজ-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম জানান, “সাইনবোর্ড থেকে চাষাড়া পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের মূল প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে গেছে। চাঁদমারী এলাকার কিছু স্থাপনা নিয়ে জটিলতার কারণে এই অংশের কাজটি শেষ করা যায় নি। আমরা শীঘ্রই সাময়িকভাবে এই অংশের ভোগান্তি কমাতে কাজ শুরু করবো।
তবে ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, “শহরে ঢুকতে এবং বের হতে এই এক কিলোমিটারেই আমাদের দিনের অর্ধেক সময় চলে যায়। মসজিদ ভাঙা হলো রাস্তার জন্য, অথচ রাস্তা ঠিক হলো না। ধুলোবালি আর গর্তের কারণে এটি এখন মৃত্যুফাঁদ।”
শহরের ভেতর: হকার, উল্টোপথ আর ড্রেনের ‘অপরিকল্পিত’ ফাঁদ
শহরের ‘লাইফলাইন’ চাষাড়া থেকে নিতাইগঞ্জ (বিবি রোড), ২নং রেলগেট এবং সিরাজউদ্দৌলা সড়কের অবস্থা দেখলে মনে হয় এখানে কোনো পরিকল্পনা বা প্রশাসনের অস্তিত্ব নেই।
শহরের প্রধান সড়ক বিবি রোডে ড্রেন নির্মাণ করতে গিয়ে অপরিকল্পনার স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে। কোনো প্রকার বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না করেই শহরের হৃৎপিণ্ডখ্যাত এই সড়কটির বিভিন্ন স্থানেÑকখনও মাঝখানে, কখনও দুই পাশে একসাথেÑবড় গর্ত করে রাখা হয়েছে। এটি বড় ধরনের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিশ্বের যেকোনো সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রে জনবহুল রাস্তায় হাত দেওয়ার আগে বিকল্প চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। জনদুর্ভোগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে উন্নয়নের ধুলোবালিতে নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠলেও কর্তৃপক্ষের যেন কিছুই যায় আসে না।
হকার ও পুলিশের ‘রহস্যজনক’ ভূমিকা:
রাস্তা যখন খোঁড়াখুঁড়িতে বিপর্যস্ত, তখন হকাররা যেন পণ করেছে রাস্তার বাকি অংশটুকুও বন্ধ করে দেবে। ফুটপাত তো কবেই গেছে, এখন মূল সড়ক দখল করে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে। আর এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা সবচেয়ে সন্দেহজনক ও দৃষ্টিকটু। চোখের সামনে অবৈধ দখল চললেও তারা নির্বিকার। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নÑশহরে কি আদৌ কোনো পুলিশ বা প্রশাসন আছে? ৫ আগস্টের পর ট্রাফিক আইন মানার বালাই নেই, উল্টোপথে গাড়ি চলছে দেদারছে।
জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং সিটি কর্পোরেশনÑএই তিন সংস্থার চরম ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতায় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন মনে হয় নাগরিকরাই এই শহরের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাঙ্গাত্মক সুরে নগরবাসী বলছেন, “উন্নয়ন কাজের জন্য আমরাই হয়তো ডিস্টার্ব করছি। আমরা শহর ছেড়ে চলে গেলেই হয়তো কর্তৃপক্ষের শান্তি হতো।”
পঞ্চবটি-মুক্তারপুর: বিসিকের ৩ লাখ শ্রমিকের কান্না
শিল্পনগরী বিসিক ও ফতুল্লা এলাকার ‘লাইফলাইন’ পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়কটি এখন খানাখন্দে ভরা। এখানে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ লেন সড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ চলছে। প্রকল্পের ধীরগতিতে এই রুটে চলাচলকারী বিসিকের ৩-৪ লাখ শ্রমিক এবং রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী যানের চালকসহ স্থানীয়রা চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন।
তবে এই চরম অচলাবস্থার মধ্যেও কর্তৃপক্ষের সাময়িক পদক্ষেপে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তীব্র ভোগান্তি সামাল দিতে পঞ্চবটি মোড়ের আগে সড়কের দুই পাশে অস্থায়ীভাবে রাস্তার কিছু অংশ বর্ধিত করা হয়েছে। এতে যানবাহনের জট কিছুটা কমেছে এবং সাধারণ মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করেছে। তবে যাত্রীদের অভিমতÑরাস্তার আরও কিছু সংকীর্ণ অংশে যদি একইভাবে সম্প্রসারণ করা যেত, তবে ভোগান্তি আরও অনেকাংশে কমে আসতো।
একইসাথে সাধারণ জনগণ ও শ্রমিকদের দাবিÑনিচের রাস্তা পুরোপুরি সংস্কার ও চলাচলের উপযোগী না করেই ওপরে উড়ালসড়কের (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) কাজ ধরাটাই ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। যদি নিচের সড়ক আগে ঠিক করে তারপর উপরের কাজ শুরু করা হতো, তবে আজকের এই অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
উড়ালসড়ক প্রকল্প সুত্রে জানা গেছে, “ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।”
এই সড়কগুলোর কারণে সৃষ্ট ভোগান্তি ও বিশাল ক্ষতির বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, চাষাড়া-পঞ্চবটি সড়কটির চাষাড়া অংশে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো এবং ট্রাফিক পুলিশের ডাম্পিং স্পটের সামনে কিছু দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছে। এগুলো সরিয়ে নিয়ে সড়কটি দ্রুত প্রসস্ত করার দাবি জানান তিনি।
পাশাপাশি পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়কে নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের নীচের রাস্তাটি দ্রুত সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করারও দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, এই সড়কগুলোতে সৃষ্ট ভোগান্তির কারণে আমাদের বায়াররা প্রায়ই দীর্ঘ জ্যামে আটকা পড়ে থাকে, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে চরমভাবে এর প্রভাব পড়ছে। তাই অতি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে বলেন তিনি।
শহরজুড়ে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়িতে বাতাসে ধুলার পরিমাণ বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। মাস্ক ছাড়া রাস্তায় বের হওয়া এখন অসম্ভব। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “শহরের বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করছে। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া ও অ্যাজমার প্রকোপ বেড়েছে। এই মুহূর্তে রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটানো অত্যন্ত জরুরি।”
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব মো. নূর কুতুবুল আলম বলেন, “জনগণের ভোগান্তি কমাতে আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে শহরের মূল অংশের ড্রেন কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। একইসাথে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহরের প্রধান সড়কগুলোর ড্রেনের কাজও শেষ হবে বলে জানান তিনি। তবে, শাখা সড়ক ও ড্রেনগুলোর কাজ আগামী জুন মাসের মধ্যে শেষ হবে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে নবাগত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রায়হান কবির বলেন,
তবে আশ্বাস নয়, নারায়ণগঞ্জবাসী এখন মুক্তি চায়। তাদের দাবিÑমসজিদ সরানোর মতো ত্যাগ স্বীকার করার পরেও কেন উন্নয়ন আটকে থাকবে? সমন্বয়হীন এই খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হোক, এবং প্রশাসন প্রমাণ করুক যে তারা নাগরিকদের ‘বোঝা’ মনে করে না।