টানা ৬ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে...

মারা গেলেন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া সেই সুব্রত

771
অবশেষে মারা গেলেন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া সেই সুব্রত

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

অবশেষে মৃত্যুর সাথে টানা ৬ দিন পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মম শিকার হওয়া হোসিয়ারী শ্রমিক সুব্রত মন্ডল। শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে সাইনবোর্ডস্থ প্রো অপটিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। সুব্রত শহরের জিউসপুকুর পাড় শনিমন্দির সংলগ্ন এলাকার মাঈনুদ্দিন মিয়ার বাড়ীর ভাড়াটিয়া সুরেশ মন্ডলের ছেলে। এ ঘটনায় রোববার সুব্রতের মা গৌরি মন্ডল বাদি হয়ে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

জানাগেছে, গত ১৫ মে মায়ের সামনে থেকে পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্র ঠেকিয়ে সুব্রতকে সায়েম ওরফে ইয়াবা সায়েম গংরা তুলে নিয়ে যায়। সুব্রতকে সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গিয়ে তার উপর চালানো হয় মধ্যযুগীয় নির্যাতন। ইয়াবা সায়েম, সাজিত, নাঈমুদ্দিন সাজু, দোলন, রাকেশ, ড্যান্ডি আল আমিন, শুভ, ভোটকা শুভ, নিরভ, প্রণয়, নোমান সিকদার, অন্ত সাহা, নাপতা প্রিতম, রিংকু, সুদেব, রাজিব, তন্ময় ও রিয়াদসহ প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন সন্ত্রাসীরা তার উপর পশুদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে মারধর শুরু করে। শুধু তাই নয়, সুব্রতকে হত্যার উদ্দেশ্যে দেশিয় অস্ত্রদিয়ে তার একাধীকস্থানে কোপও দেয়। এসময় সুব্রতের প্রাণভিক্ষার চিৎকারও ওইসব সন্ত্রাসীদের মন গলাতে পারেনি। যতবার সুব্রত প্রাণভিক্ষা চায়, ততবারই সন্ত্রাসীরা তাদের টর্চার আরও বাড়িয়ে দেয়। কখনো সুব্রতের আঙ্গুল কেটে ফেলে, পায়ে কোপ দেয়, শরীরে লাঠিপেটা করে ইত্যাদি টর্চার করতেই থাকে।

মারা গেলেন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া সেই সুব্রত

পরে মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে সন্ত্রাসীরা সুব্রতকে রাত পৌনে ২টার দিকে তার বাড়ীর সামনে ফেলে রেখে যায়। এদিকে মৃত প্রায় সুব্রতকে তার বাড়ীর সামনে পরে থাকতে দেখে এলাকাবাসী তার আত্মীয় স্বজনকে খবর দেয়। পরে সেখান থেকে সুব্রতকে দ্রুত উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ১’শ শয্যা (ভিক্টোরিয়া) জেনারেল হাসাপাতালে নেওয়া হলেও সুব্রতের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে সাথে সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রের্ফার করে। সুব্রতের আইসিওর বেড প্রয়োজন হওয়া সেখান থেকে সুব্রতকে সাইনবোর্ডস্থ প্রো অপটিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েকদিন আইসিও বেডে রাখার হলেও বিভিন্ন পরীক্ষা নিরিক্ষার শেষে ডাক্তার বলেন, সন্ত্রাসীদের মারধরের কারণে তার দুটি কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে এবং তার অবস্থার আরও অবনতির হওয়ায় তাকে লাইফ সার্পোটে রাখা হয়। শনিবার দিবাগত লাইফ সার্পোটে থাকা অবস্থাতেই সুব্রতের মৃত্যু হয়।

এর আগে মৃত্যুর আগে সুব্রত তার উপর হামলাকারীদের নাম ও হামলার কারণ বর্ণণা করে গেছেন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয় এবং যা পরবর্তিতে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিও ফুটেজে সুব্রতকে বলতে দেখা গেছে, যেসব সন্ত্রাসীরা সুব্রতের উপর হামলা চালিয়েছিলো তারা সবাই বর্তমান কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনিরে লোক। নির্বাচনে সুব্রতে মনিরের পক্ষে কাজ করার জন্য চাপ দিয়েছিলো ওই সন্ত্রাসীরা। কিন্তু করোনাকালে এবং সব সময় সুব্রতের পরিবারকে সাবেক কাউন্সিলর সফিউদ্দিন প্রধান নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা করায় সুবত্র বলেছিলো, আমি মনিরের পক্ষে কাজ করতে অস্বীকার জানায়। এবং নির্বাচনে সফিউদ্দিনের পক্ষে কাজ করে। এর রেশ ধরেই সন্ত্রাসীরা তাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে বলে সুব্রত জানিয়েছিলেন।

নিহত সুব্রতের পরিবারের কান্না-আহাজারী

এদিকে সুব্রতের মৃত্যুকে সহজে মেনে নিতে পারছেন না তার আত্মীয় স্বজন ও এলাকাবাসী। সুব্রতের মরদেহ এলাকায় আসার পর কান্নার রোল পড়ে যায়। এসময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুব্রতের মা সহ সকল আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও এলাকাবাসী। তাদের আত্মচিৎকারে পরিবেশ ভারি হয়ে আসে। এলাকাবাসী সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিলও করেন। এসময় মিছিলে থাকা শত শত মানুষ ‘সুব্রতের রক্ত, বৃথা যেতে দিবো না, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, সুব্রতের খুনিদের ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। মিছিল শেষে স্থানীয় এলাকাবাসীরা বলেন, আপনারা সবাই জানেন মৃত্যুর আগে সুব্রত সব বলে গিয়েছে, কেন এবং কি কারনে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ওই সকল সন্ত্রাসীদের ফাঁসি চাই। যতদিন ওই সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার না হবে এবং তাদের ফাঁসি না হবে আমাদের এ আন্দোলন চলবে।

এ বিষয়ে সাবেক কাউন্সিলর সফিউদ্দিন প্রধানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার এলাকার অনেক যুবকরাই আমার জন্য নির্বাচন করছে। আমার পক্ষে নির্বাচন করতে গিয়ে যদি কারো জীবন দিত হয়, তাহলে এমন নির্বাচন আমি আর করবো না। এর আগেও সুব্রত সহ আমার পক্ষে যারা কাজ করেছে, তাদের সবাইকে হুমকি ধামকি দিয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি এটা সামাজিক ভাবে শেষ করার জন্য। এই দীঘির পাড় হিন্দু অধ্যাষিত এলাকা, তারা খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। এখানে কখনোই সংঘাত ঘটেনি। আমরা সবাই মিলে মিশে বসবাস করছি। আজকে যে ছেলেটা চলে গেছে, যার মার বুক খালি হয়েছে সেই বলতে পারবে সন্তান হারানো বেদনা কতটুকু। আমি এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই বলছি, যারা এ হত্যাকান্ডের জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলাতে হবে, এটাই আমাদের দাবি।

অবশেষে মারা গেলেন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া সেই সুব্রত

এদিকে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারন সম্পাদক শিখণ সরকার শিপন বলেছেন, পরিবারটা একদমই নিরিহ। যে ছেলেটাকে খুন করা হয়েছে, ওই ছিলো পরিবারটা একমাত্র উর্পাজনখম। আমরা তাদের পাশে আছি এবং থাকবো। আমাদের সংগঠনের থেকে যা যা করা দরকার, আমরা তাই করবো। আমারও দাবি থাকবে, যারা এই নিরিহ ছেলেটাকে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।