ভয়ানক ভাবে প্রতারিত হচ্ছে সাধারন মানুষ, নেই মানসম্পন্ন ডাক্তার...

না.গঞ্জের ক্লিনিক ও ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারগুলির অধিকাংশই অবৈধ

155

নারায়ণগঞ্জ ফার্স্ট নিউজ:

বাংলাদেশে অব্যাহত অভিযানে নিবন্ধন না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনেস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সারাদেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা এবং চিকিৎসার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ এবার কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্র থেকে গতকাল এসব তথ্য জানা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এই অভিযানে ছোট বড় সব ধরনের হাসপাতালেই নানা অনিয়েমের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জেও এই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আর অভিযান চলাকালে নারায়ণগঞ্জে ঘটেছে সব চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। কিন্তু এই পরিস্থিতি তৈরি হল কীভাবে? ব্যর্থতা কোথায়?

নারায়ণগঞ্জ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অবৈধ হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক অভিযানের সময় নারায়ণগঞ্জের পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে অভিযান হতে পারে এমন খবরে সেখানে সদ্যজাত সন্তানসহ এক নারীকে অপরেশেন টেবিলে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন ক্লিনিকটির ডাক্তার-নার্সসহ সবাই। ঘটনাটি ঘটে রবিবার ২৯শে মে এবং সেই ঘটনা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।

পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে নিবন্ধন এবং এমনকি সার্বক্ষণিক কোন ডাক্তার না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে ক্লিনিকের গেটে যে সিলগালা করে দেয়া হয়েছল, সেই সিলগালা সেভাবেই রয়েছে।

ঘটনার কয়েকদিন পর ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল নামের সেই ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেছে, ক্লিনিকের গেটে তালা ঝুলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে ক্লিনিকের গেটে যে সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল, সেই সিলগালা সেভাবেই রয়েছে। ক্লিনিকটিতে ঘটনার শিকার নারীকে সদ্যজাত সন্তানসহ উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য কাছেই একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

তার স্বামী তানভীর হাসান বলছেন, ক্লিনিকের দালারের খপ্পরে পড়ে তারা সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমি কাজে অন্য জায়গায় ছিলাম। আমার শ্বাশুড়ি আমার স্ত্রীকে এই ক্লিনিকে নিয়া আসে। এক মহিলা দালাল আমার শ্বাশুড়িকে ভুল বুঝায়া এখানে নিয়া আসে।” তারপর ক্লিনিকে বলছে যে ১৮ হাজার টাকা লাগবে। আমরা ১২ হাজার টাকা দিলে দুই মিনিটের মধ্যে সিজার করার জন্য ভিতরে নিয়ে গেল।”

মি: হাসান আরও জানান, তার স্ত্রীকে যখন অপারেশন টেবিলে নেয়া হয়, তখন সেখানে সাংবাদিক এবং অভিযানের লোকজন আসছে বলে খবর আসে। সে সময় মুহূর্তেই সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে মি: হাসানের হাতে দিয়ে এবং তার স্ত্রীকে অপারেশন কক্ষের ভেতরে রেখেই সেই কক্ষে তালা লাগিয়ে ক্লিনিকের ডাক্তার নার্সসহ সবাই পালিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানের লোকজন এসে তালা ভেঙে তার স্ত্রীকে পাশে একটি সরকারি হাসপাতালে পাঠায় চিকিৎসার জন্য।

এদিকে আলোচিত ক্লিনিকটি যে গলিতে সেই গলিতে রাস্তার দুই পাশে বিল্ডিংগুলোতে কয়েকটি ক্লিনিক এবং ফিজিওথেরাপির সেন্টারের সাইনবোর্ড ঝুলছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, সেগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে রয়েছে ঐ ক্লিনিকে অভিযানের পর থেকে। তবে অভিযান চালানো ক্লিনিকটি যে ভবনে, সেই ভবনের একটি ফ্লোরে এখনও খোলা আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন এমন একটি ফিজিওথেরাপি সেন্টার, একটি কক্ষে সেন্টারের একজন নারী কর্মী মাইক ব্যবহার করে বেশ কয়েকজন বয়স্ক নারী-পুরুষকে ব্যায়াম করাচ্ছেন। সেখানে পাশের আরেকটি কক্ষে আটটি শয্যা। এসব শয্যায় নারী পুরুষদের কোমরে ব্যথা এবং মেরুদন্ডের সমস্যা সারাতে কোমরের নিচে একটি যন্ত্র দিয়ে থেরাপি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এই সেন্টারের নিবন্ধন না থাকায় বছর খানেক আগে কর্তৃপক্ষ এটিকে জরিমানা করেছিল।

সেখানে থেরাপি নিতে আসা একজন নারী নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, থেরাপি সেন্টারটির নিবন্ধন আছে কিনা- এনিয়ে তিনি প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করেননি। এখানেতো কোন ডাক্তার নাই। কিছু ছেলে মেয়েকে দিয়ে সেবাটা দেয়া আরকি। যেহেতু বিনা পয়সায় সেবাটা নিতেছি, সেজন্য এটা আমরা কখনও দেখি নাই যে, তাদের নিবন্ধন বা অনুমতি আছে কিনা। এগুলোতো উনারা আমাদের দেখাবে না। থেরাপি সেন্টারটিতে ‘কোন অর্থ ছাড়াই সেবা দেয়া হয় এই অফার দিয়ে প্রথমে রোগীদের আকর্ষণ করা হয়।

এরপর কোন রোগীকে সপ্তাহ দুয়েক বিনামূল্যে সেন্টারে থেরাপি দেয়ার পর তাকে নিজেই যন্ত্র ব্যবহার করে থেরাপি নিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এজন্য বেডসহ প্রতিটি যন্ত্র ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয় বলে ঐ সেন্টারে থেরাপি নেয়া একাধিক ব্যক্তি জানান।

তবে থেরাপি সেন্টারটির মালিক ফখরুল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অনুমোদন ছাড়া তারা ক্লিনিক চালাচ্ছেন কীভাবে এ প্রশ্নে তিনি বলেছেন, অনুমোদন নেয়ার প্রক্রিয়া তিনি চালাচ্ছেন। এদিকে জেলা প্রশাসন থেকে থেকে লোক এসে আমাদের কাগজপত্র দেখে বলেছে তা ঠিক আছে। আর ডিজি হেলথ থেকে একটা কাগজ দরকার ছিল। আমরা এখন সেই কাগজের জন্য কাজ করছি,” বলেন ফখরুল ইসলাম।

এরপর সিদ্ধিরগঞ্জেই দশ শয্যার একটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার শুধু একজন। সার্বক্ষণিক কোন ডাক্তার নেই। সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তার বেসরকারি ঐ হাসপাতালটিতে বিকেলে রোগী দেখেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সরেজমিনে যে চিত্র পাওয়া গেছে, সেই একইরকম অভিযোগ পাওয়া যায় দেশের অন্য অনেক জায়গা থেকেও। তবে নারায়ণগঞ্জে এখন এই অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল ব্যাবসা জমজমাট বলেই জানা গেছে। ঠিক মতো অভিযান পরিচালনা করলে দেখা যাবে নারায়ণগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা এমন ক্লিনিক এবং ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারের অধিকাংশেরই কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই এবং কোনো মান সম্পন্ন ডাক্তার নেই।